জাগো বাঙালি জাগো

জাগো বাঙালি জাগো

জাগো বাঙালি জাগো !

বাঁচতে যদি চাও, তবে এবার জাগো,

জাগতে যদি না পারো, তবে তুমি ভাগো;

জাগোরে জাগো জাগো !

 

শোনো, না জেগে বাঁচা মানে মিথ্যে বাঁচা,

রুহ বিনে দেহ__ সেটা তো মিথ্যে খাঁচা;

বাঁচার আহ্বানে যে জাগ্রত নয়,

সেই মিথ্যে খাঁচার কোনো মানে হয়?

পূর্ণ করে বাঁচতে চাও এ জীবন?

“নিজের বল না যেন টুটে” __ করো পণ;

নির্ভয়, নিরলস, নিঃসংশয় মন,

কোনো মানবশরীরে না থাকে যখন,

“ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো” __ ওগো,

                                    তা কি বোঝো না’ক?

                                  জাগো বাঙালি জাগো  ।।

 

মাভৈঃ! জাগো ! জাগো !

বাঁচতে যদি চাও, তবে এবার জাগো,

মরতে যদি না চাও তো এবার জাগো,

জাগোরে জাগো জাগো!

 

কালে কালে “জগতজুড়ে প্রলয় আসে”,

নতুন আসে সেই ধ্বংসের বিনাশে,

সৃজনলক্ষ্য ধ্বংসে যদি পাও ভয়,

ত্রস্ত নিঃশ্বাস তো জীবন নয়!

হে জীবনোন্মুখ উঁচু শির বাঙালি,

লহুতে তোমার শিব, চেঙ্গিস, আলী;

তুর্কি দামাল কামাল তোমার ভাই,

ইমাম হোসেন কি তোমার ইমানে নাই?

জুলফিকার, হায়দারি হাঁক হাঁকো,

                           ন্যায় সুমুখে আগো;

                        জাগো বাঙালি জাগো ।।

 

হৈহৈ নিনাদে জাগো!

জিততে যদি চাও তবে এবার জাগো

হারতে যদি না চাও, তো এবার জাগো

জাগোরে জাগো জাগো!

 

ঐ ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, তিতুমির,

মেনেছে মৃত্যুকে, মানেনি জিঞ্জির;

বায়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তর

এনেছে মুক্তি এনেছে একাত্তর,

সেই হাতিয়ার ধরে আবার জাগোরে,

সাম্য, সুবিচার আর মর্যাদারে

নাও আবার অন্তরে যেমন করে

একাত্তরে জাগতে ঐ তেমন করে

হাঁক ছেড়ে তুমি বাংলার বুকে হাঁকো;

                     সে ডাকে তুমি ডাকো,

                      জাগো বাঙালি জাগো ।।

 

জয় বাংলা! জাগো,

সদা তোমার স্বাধীনতা বাঁচাতে জাগো,

সদা তোমার স্বাধীনতা বাড়াতে জাগো,

জাগোরে জাগো জাগো!

 

লাখো শহিদের জীবনে ও সম্ভ্রমে,

আপামর জনতার শ্রমে ও ঘামে

প্রাপ্ত স্বাধীনতার মালিক জনতা,

এ স্বাধীনতার রক্ষকও জনতা;

আমাদের স্বাধীনতার মানে তাই: জনতার অধিকার,

সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার,

মনে রেখো,  “এ স্বাধীনতা সস্তা নয়”

কখনো “আজাদী মেলে না পস্তানোয়

স্বাধীনতায় কখনো আঘাত এলে গো,

                              ত্বরিত তুমি রুখো,

                  জাগো বাঙালি জাগো !

জয় জনতা! জাগো!

বাংলার সব মানুষকে বাঁচাতে জাগো!

অর্থ, মান ও জীবন বাঁচাতে জাগো!

জাগোরে জাগো জাগো!

 

হে বাঙালি, গুজবে ও হুজুগে নেচো না,

কোনো কপটের ছলে নিজেকে মেরো না,

তোমার বিবেক ও বিচক্ষণতার

সবটুকুরই করো সদ্ব্যবহার।

বাঁচার জন্য জাগো! জাগার জন্য বাঁচো!

এ পৃথিবীতে তো বাঁচতেই তুমি আছো।

তোমার বেঁচে থাকার কোনো সঙ্কটে,

নিত্যই নিপীড়িত দিন যেন না কাটে,

বারবার নয়, একবার মরবে গো?

                 তার জন্য তুমি জাগো!

                জাগো বাঙালি জাগো ।।

 

ভাবার্থ:

হাজার বছরের সংগ্রাম-লড়াইয়ের সম্মিলিত ফসল বিশ্বমানচিত্রে আজকের এই সার্বভৌম বাংলাদেশ, আর স্বাধীন বাঙালি জাতি। বাঙালির চিন্তার স্বাতন্ত্র, মুক্তির স্পৃহা আর অধিকারের চেতনাবোধ বাঙালিকে এই উপমহাদেশে এক স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সাহায্য করেছে। এরই প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে নানা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট__ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষার লড়াই, ছয় দফার ম্যাগনাকার্টা, গণঅভ্যুত্থান, আর একাত্তরের গণযুদ্ধ, মহান মুক্তিযুদ্ধ __ এর মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ।

লাখো শহিদের রক্ত, লাখো মা-বোনের সম্ভ্রম, আর কোটি ভাইয়ের লড়াই, রক্ত ও ঘামে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা এই জাতির নিকট সবকিছুর থেকে মূল্যবান। আমাদের স্বাধীনতার মূললক্ষ্য “সাম্য, মানবিক মর্যাদাবোধ ও সামাজিক সুবিচার”

আমাদের স্বাধীনতার মূল প্রেরণা: (১) বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যে মন্ত্রে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয় (২) সমাজতন্ত্র, যেই ব্যবস্থায় সকল বৈষম্য দূরীভূত হয়, সাম্যবাদী ন্যায়ুনুগ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় (৩) গণতন্ত্র, যা এই দেশের মানুষকে এদেশের মালিকানার সদ্ব্যবহারের সুযোগ করে দেয় এবং জনগণকে স্বাধীন স্বত্তায় বিকাশের জন্য সবরকম মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেয় (৪) ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, যা জনগণের মধ্য হতে বিভক্তি ও বৈষম্য দূর করে।  এসব কারণেই স্বাধীনতা আমাদের জাতির প্রতিটি সদস্যের অস্তিত্বের প্রশ্ন।

কখনো যদি এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত আসে, তাইলে যেন জনগণ ১৯৭১-এর মত করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই চেতনাই মনে ধারণ করে স্বাধীনতার সুরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে__ এটাই এই কবিতার আহ্বান।

এজন্য এ কবিতার কিছু স্তবকে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গীতাঞ্জলির জীবনদর্শন আর এর সঙ্গে সমগ্র কবিতা জুড়ে মেশানো হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত অগ্নিবীণার দ্রোহ

গীতাঞ্জলিতে যে নির্মল, নির্ভয়, জাগ্রত, উদ্যত মনন গঠনের দর্শন ফুটে ওঠে, তার সঙ্গে অগ্নিবীণার দ্রোহকে মেশালে মনে হয়: এই তো বাংলাদেশের সৃষ্টির সুর। একারণেই বুঝি বাঙালির স্বাধীকারের সংগ্রামের দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের গান-কবিতা এতটা দ্যোতনা দেয়।

বিশ্বকবি  গীতাঞ্জলিতে বাঙালিকে যে দর্শন উপহার দিয়েছেন, তা আমাদের হাজার বছরের বেঁচে থাকার প্রেরণা। স্বার্থক ও সুন্দর জীবনের জন্য চাই এমন মন যে “শুধু আপনাকে ঘেরিয়া ঘেরিয়া পলে পলে ঘুরে মরবে না”; বরং জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে মানুষের তরে অকাতরে বিলাবে, দূরকে বন্ধু করে পরকে ভাই বানাতে দ্বিধা করবে না। শুদ্ধ নির্মল মন সঙ্কোচের বিহ্বলতায় নিজেকে অপমানিত করবে না। সঙ্কটে ম্রিয়মাণ হবে না। দুঃসময়ে বরং নিজেকে জাগ্রত, উদ্যত, নির্ভয় ও নিরলস হয়ে দুরূহ কাজে নিজের কঠিন পরিচয় দেবে। বিপদে নিজের বলের ওপর আস্থা রেখে সত্যকে আঁকড়ে এগিয়ে যাবে।

বিশ্বকবির এই নির্মল চেতনা বাঙালিকে নিজের সংকীর্ণ স্বার্থ ভুলে জাতীয় প্রয়োজনের লড়াইয়ে নির্ভীক-নিরলস হয়ে সংগ্রাম করার প্রেরণা দেয়।

জাতীয় কবির অগ্নিবীণার দ্রোহ সুদূর বিস্তৃত। অনার্য অস্ট্রালয়েড, আর্য, আরব, মঙ্গোল, তুর্কি নানা জাতির মিশেলে যে বাঙালির সৃষ্টি, তা মনে করিয়ে দেয় অগ্নিবীণা। তাই তো, আমাদের পূর্বপূরুষের সকল শাখার বীরসেনানীরা কীভাবে সত্যের সংগ্রাম সংসপ্তক, শহিদ কিংবা গাজী হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন, সেই ইতিহাস তুলে ধরেছেন, সেই বীররসের সুরে, সেই বিদ্রোহের দ্যোতনায়।

এ কারণেই এ কবিতায় গীতাঞ্জলির মননে, অগ্নিবীণার দ্রোহে ও  একাত্তরের চেতনায় জাগরূক হবার আহবান জানানো হয়েছে মহান স্বাধীনতার সবটুকুর সুরক্ষার তাগিদে।

এমন দেশাত্ববোধক  কবিতা আরো পড়ুন

১. কবিতা নয়, যুদ্ধে এসো

২. লাল দিয়েই লিখ মহাকাল 

 

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়ুন

১. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধান ও কোটাব্যবস্থা 

author

রাজা আবুল কালাম আজাদ

Raja Abul Kalam Azad is a post-modern researcher, writer, journalist, environmental activist, and teacher. He completed his bachelor's and master's degrees in disaster management at the University of Dhaka. His various research articles have been published in reputed international journals. Currently, he is working as a teacher at a government school and serving as the coordinator of the Disaster Economics Unit of Disaster Perception, a Dhaka-based organization. He is the Secretary General of 'Muktatma Samiti' and one of the Members of the Independent Bangla Editorial Board.

এই ধরণের আরো...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial