জেরুসালেমের মালিকানা পরীক্ষা

জেরুজালেম, ইয়ারুসালেম, আলকুদস, বাইতুল মুকাদ্দাস। এক শহরের এই ক’টা নাম। এই নামগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো বছর, হাজারো সভ্যতা, হাজারো ইতিহাসের ছোঁয়া। তাইতো, এই হরেক নামের একটি শহরের এতো দাবিদার। ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদি, তিনটি ধর্মের, তিনটি আবেগের, তিনটি জাতির অধিকারের দাবিই এই শহরটি। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দু’টি স্বতন্ত্র দেশই দাবি করে শহরটিকে তাদের রাজধানী করবে! এতোগুলো দাবিদার স্বপ্ন দেখে ভিন্ন ভিন্ন চোখে, ভিন্ন ভিন্ন আবেগে, নিজেদের মত করে। কিন্তু, কি করবে এই একা এক শহর জেরুজালেম! ওর তো দু’টো শরীর নেই, দু’টো আলাদা অবস্থান নেই, আলাদা অবয়ব নেই!

তবে, কার স্বপ্নে সাঁজবে ও? -মুসলমানের? খ্রিস্টানের নাকি ইহুদির? ইসরায়েলের নাকি ফিলিস্তিনের?

ওর তো একা ক্ষমতা নেই সবার মনের মতো করেই সাঁজার, সবার মন জোগানোর, সবার স্বপ্ন পূরণের।কারন, দাবিদার প্রত্যেকের স্বপ্ন আলাদা, আবেগ আলাদা, চাহিদা আলাদা। প্রত্যেক পক্ষই চায় তাদের স্বপ্নের শহর তার চাহিদা-চাওয়া পাওয়া মোতাবেক হোক। সেই জন্যই পক্ষগুলোর আলাদা আলাদা প্রচেষ্টা, আলাদা আলাদা জিহাদ, আলাদা আলাদা আন্দোলন। আর এই বহুমুখী আন্দোলনের ফলেই সংঘর্ষ, রক্তপাত, ক্রুসেড, এথনিক ক্লিনসিং, যুদ্ধ বিগ্রহ।

এই একটা শহরের কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে এতো এতো রাজনীতি, এতো এতো কুটনীতি, এতো এতো যুদ্ধ, বিগ্রহ, পক্ষ, বিপক্ষ, তৃতীয় পক্ষ, চতুর্থপক্ষ;স্থানীয়পক্ষ, প্রতিবেশীপক্ষ, বহিরাগত পক্ষ।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিতে আক্রমণ করা হয় অন্তত ৫২ বার, অবরোধ করা রাখা হয় ২৩ বার এবং দখল-পুনর্দখলের ঘটনা ঘটে অন্তত ৪৪ বার। এর মধ্যে আবার দুই শহরটিকে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করে ফেলা হয়। তিনবার শহরটিকে নতুন করে গড়ে তোলা হয়। একই জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন হাতে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা গড়ে ওঠে শহরটি। এখন প্রশ্ন, শহরটির প্রকৃত দাবিদার কে? সর্বপ্রথম যিনি গড়েছিল সে? নাকি সর্বশেষ যিনি তার বংশধরেরা? আজ যার দখলে আছে সে? নাকি গতকাল যার দখলে ছিল তাদের? নাকি আগামীকাল যার দখলে যাবে তাদের? দেখি পরীক্ষা করে প্রতিটি পক্ষের দাবিকে।কার দাবি বেশি যৌক্তিক, কার দাবি বেশি ন্যায়সংগত, হয়ে যাক পরীক্ষা।

প্রথম পরীক্ষণঃ প্রথম নির্মাতার পরম্পরাগত অধিকার

জেরুজালেমে সর্বপ্রথম কে বা কারা বসতি স্থাপন করেছিল এই ইতিহাস জানা যায় নি। সর্বপ্রথম কারা শহর প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেটা নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে। এরমধ্যে, সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মত হলো, খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার আগে রাজা দাউদ (আ:) এই শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজা দাউদ (আঃ) হলো ইবরাহিমের (আ:)এর বংশধর। ইহুদিদের দাবি, দাউদ (আ:) তাদের নবী। তাই উত্তরাধিকার সুত্রে, তারাই জেরুজালেমের দাবিদার।
কিন্তু, তাদের এ দাবিতে বাগড়া খ্রিস্টান ও মুসলমানদের। খ্রিস্টানদের দাবি, দাউদ (আ:) তাদেরও নবী ছিলো। আর দাউদের বংশধর মাতা মেরি। মেরি গর্ভেই যিশুর জন্ম। যিশুর ১২ শিষ্য, প্রথম ৩শ বছরের সকল খ্রিস্টান সবাই দাউদেরই (আঃ) বংশধর।তাই, বংশপরম্পরাগত অধিকার খ্রিস্টানদেরও আছে।
মুসলমানদের দাবি দাউদ (আ:)তাদেরও নবী। তাদের আরো দাবি, দাউদ (আঃ) নবীর বংশধরদের বেশির ভাগই মুসলমান হয়ে গেছে। ফলে, বংশ পরম্পরাগত ভাবে জেরুজালেম তাদেরই প্রাপ্য।

 

দ্বিতীয় পরীক্ষণঃ শেষ নির্মাতার পরম্পরাগত অধিকার

সকল ঐতিহাসিক একমত, রাজা দাউদে (আঃ) এর প্রস্তুতকৃত কিছুই অবশিষ্ট নেই। পুরান জেরুজালেমে সবচেয়ে পুরাতন যে স্থাপনা, সেটা হলো, ‘টেম্পল মাউন্ট, বা হারাম আল শারিফ, বা হার হা বাইত’। ইহুদিদের দাবি, তাদের ‘হার হা বাইত’ তৈরি করেছিল রাজা দাউদের (আঃ) পুত্র রাজা সুলাইমান (আঃ)। এটাকে তারা ‘সৃষ্টিকর্তার ঘর’ হিসেবে সম্মান করে। এজন্যই জেরুজালেমকে কবজা করে রাখতে তারা এতোটা মরিয়া।

খ্রিস্টানদের দাবি, ৫৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনিয়রা জেরুজালেমকে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করে দেয়।এসময়, হারাম হার হাবাইতেরও কিছু অবশিষ্ট ছিল না।

পরে ইহুদি রাজা জুরাব্বেল এটা তৈরি করলে ৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমানরা আবারো এটাকে ধংস করে দেয়। রোমানরা তার পাশে জুপিটার ক্যাপিটোলিনাসের মন্দির স্থাপন করে। খ্রিস্টানরা দাবি করেন, এই মন্দিরেই যিশু খ্রিস্ট ধর্মের দাওয়াত দেন। আর, ৩৩৫ সালে খ্রিস্টানরা জেরুজালেমে CHURCH OF THE HOLY SEPULCHRE নির্মাণ করে। তাদের দাবি, এই জায়গাটাতেই যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, এইখান থেকেই জেগে উঠে যিশু শিশ্যদের নিকট সাক্ষাৎ করেন। যিশুর স্মৃতি বিজড়িত এই জেরুজালেমের অধিকার ছাড়তে তারা নারাজ। এই দাবিকে কেন্দ্র করেই ১০৯৯ সালে ইউরোপীয় খ্রিস্টানগণ জেরুজালেম আক্রমণ করে। বর্তমান ফিলিস্তিন ও ইজরায়েলের অধিকাংশ জায়গা দখল করে ‘কিংডম অব জেরুজালেম’ প্রতিষ্ঠা করে, যা ১১৯২ সাল পর্যন্ত জেরুজালেমে খ্রিস্টীয় শাসন কায়েম করে রেখেছিল।এসময় তারা ‘মুসলিমদের থেকে অধিকৃত কুব্বাতুস শাখরাকে ‘ডোম অব রক’ নাম দিয়ে চার্চ হিসেবে ব্যাবহার করে। জেরুজালেমের সমস্ত ইহুদি ও মুসলমানকে হত্যা করে। সেই হারানো ‘কিংডম অব জেরুজালেমের’ স্বপ্ন দেখেন অনেক খ্রিস্টান এখনো।

মুসলমানদের দাবি, নবী সুলাইমান যেখানে মসজিদ তৈরি করেছিল, সেই ভিটা ৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৯১ খ্রিস্তাব্দ পর্যন্ত পতিত ছিল। এই জায়গাতেই ৬৯১ সালে উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক ‘কুব্বাতুস শাখরা নির্মাণ করেন’। ১০১৫ সালে প্রাকৃতিকভাবে এটি ভেঙ্গে গেলে ১০২২-২৩ সালে এটি আবার নির্মাণ করা হয়। এর আগে, এই ‘কুব্বাতুস শাখরা’র পাশে খলিফা উমর ছোট্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ৭০৫ সালে খলিফা আব্দুল মালিক এটি সম্প্রসারণ করেন। এই মসজিদটিই বর্তমানে ‘মসজিদে আকসা’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ অবশ্য ‘কুব্বাতুস শখরা’, ওয়েলিং ওয়ালসহ পুরো চত্বরটিকেই ‘মাসজিদুল আকসা’ বলে ডাকে।১০৯৯ সালে খ্রিস্টানরা জেরুজালেম দখল করে নিলেও এর কোন স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলে নি। বরং, মুসলিমদের তৈরি স্থাপনাই চার্চ, স্কুল, প্রভৃতি হিসেবে ব্যাবহার করে থাকে। এই হিসেবে, মাসজিদুল আকসা চত্বরের বর্তমান স্থাপনাগুলো যেহেতু মুসলিমদের তৈরি, তাই এগুলোর দাবিদার তারাই।

তৃতীয় পরীক্ষণঃ ধর্মীয় দাবি

ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদি তিনটি ধর্মই দাবি করে ‘জেরুজালেম’ তাদের একচ্ছত্র অধিকার।আবার, কোন ধর্মেই অপর ধর্মের অধিকার স্বীকৃত নয়।

ইহুদিদের মতে, ‘ইসরায়েল’ ঈশ্বর কর্তৃক ইহুদিদের জন্য প্রদত্ত ভুমি। জেরুজালেম, হাইফা, জেরিকোসহ ইসরায়েলের প্রত্যেকটি ধূলিকণার অধিকার তাদের একচ্ছত্র।এখানে ইব্রাহিম, দাউদ, সুলাইমানের(আঃ)রাজত্ব।স্রষ্টার নির্দেশে মুসা নবী(আঃ)তাদেরকে মিশর থেকে ডেকে এনে বসতি স্থাপন করিয়ে দিয়েছিলেন। এই ইসরায়েলের এক কানি জমি ছাড়তে তারা নারাজ।

খ্রিস্টানদের মতে, ঈশ্বরের পুত্র যিশু। তার ক্রুসিফিকশন(ক্রুশবিদ্ধ হওয়া) ও রিজারেকশন (কবর দেওয়ার পর যিশু ৩ দিন পর উঠে এসে শিশ্যদের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন) যে মানবে না, তারা ঈশ্বরের লানত প্রাপ্ত। ইহুদিরা যিশুর হত্যাকারী। মুসলিমরা যিশুকে নবী হিসেবে মানলেও ‘ক্রুসিফিকশনও রিজারেকশন’ বিশ্বাস করে না, ঈশ্বরের পুত্র হিসেবেও মানে না। সুতরাং, বিশ্বাসগতভাবে ইহুদি ও মুসলমানগণ খ্রিস্টানদের নিকট বিধর্মী। ‘যিশুর জন্মভুমি’ এই বিধর্মীদের হস্তগত হয়ে থাকবে এটা খ্রিস্টানগণ মানতে নারাজ। এইজন্যই জেরুসালেমের দখল নিতে ক্রুসেড, রক্তারক্তি, আর ‘কিংডম অব জেরুজালেমের’ আবির্ভাব।

মুসলমানদের দাবির কারণ অনেক। তারা মনে করেন, নবী মুহাম্মাদের (আঃ) আগমনের পর ইহুদি-খ্রিস্টান-হিন্দু সবার অবশ্য কর্তব্য ইসলাম গ্রহণ করা। তাদের মতে, ইসলামগ্রহণকারী ব্যাতিত সকলে বিজাতি-বিধর্মী এবং অপবিত্র। পরকালে অমুসলমান মাত্রেই জাহান্নামী। এদিকে জেরুজালেমের বাইতুল আকসা তাদের নিকট মক্কা ও মদিনার পর তৃতীয় পবিত্রতম স্থান।নবী মুহাম্মাদ (সা:) মেরাজে যাওয়ার সময় এই জেরুজালেম থেকেই ঊর্ধ্ব আকাশে গমন করেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কয়েকবছর মুসলমানগণ এই জেরুজালেমের দিকেই মুখ ফিরে নামাজ পড়েছেন। এদিক ছাড়াও,পৃথিবীর যেকোন মসজিদে সকল প্রকার বিধর্মীর প্রবেশ নিষিদ্ধ, কারন তারা অপবিত্র। তাই, পবিত্র জেরুজালেমের ‘পবিত্রতা রক্ষায়’ তারা সদা সংকল্পবদ্ধ।

চতুর্থ পরীক্ষণঃ রাষ্ট্রীয় দাবি

জেরুজালেম কার? ইসরায়েল নাকি ফিলিস্তিনের? এটাই মূলত আসল প্রশ্ন। কারণ, এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরই নির্ভর করছে, কোন ধর্মের দাবীগুলোর কতটুকু কীভাবে পূরণ করা হবে। আবার, জেরুজালেমের রাষ্ট্রীয় দাবির ভিত্তিটাও নির্ণীত হবে ধর্মীয় দাবীগুলোর ন্যায়তার ভিত্তিতেই। এই একটা প্রশ্নের উত্তরের ওপরেরই নির্ভর করছে, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, আরব উপদ্বীপ তথা মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ সমস্যার উত্তর। এতদাঞ্চলের অধিকাংশ সমস্যার সমাধানও নির্ভর করছে এই একটি সমস্যার সমাধানের মধ্যে।
জেরুজালেমের অধিকার কোন রাষ্ট্রের, এই একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, খুঁজতে হবে আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর। এর প্রথম প্রশ্নটি হল, ইসরায়েলের ভূমিটি আসলে কার? এই প্রশ্নের উত্তরে ১৯৪৮-৪৯, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩, ১৯৮২ সালের ভয়াবহ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। ১৯৪৮ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা মাসে অজস্র মানুষের রক্ত ক্ষরণ! প্রশ্নটির সমাধানযোগ্য উত্তর তাই সহজ নয় মোটেও, সস্তা নয় কোনভাবেই। তবুও, আমি আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো, জেরুজালেম তথা এতদঞ্চলের প্রকৃত রাষ্ট্রীয় দাবিদার কারা।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন এলাকার ভুমির কারা? এই প্রশ্নের উত্তর এক বাক্যে দেওয়া সম্ভব নয়।এর পেছনে রয়েছে বহু ইতিহাস, বহু দাবি বহু যুক্তি। জানা ইতিহাস থেকে চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত ইহুদিরা এই এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তবে, এর আগে যে কেউ ছিল না টা নয়। এর আগেও এখানে অনেক প্রাচীন সভ্যতা ছিল, ধর্ম ছিল, নানা জাতি ভাষাভাষী লোকজন ছিল। খ্রিস্ট ধর্মের আবির্ভাবের পর থেকে প্রথম তিনশ বছর খ্রিস্টানরা এখানে সংখ্যালঘু ছিল। ১১৯২ সালে এরপরে সালাউদ্দিন কর্তৃক জেরুজালেম দখলে নেওয়ার পর এই অচিরেই এই এলাকায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।একটানা ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এই এলাকায় মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকে। এই এলাকায় ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদি জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটে। ২০১১ সালের আদমশুমারি মোতাবেক, ইসরায়েল শাসিত জনগণের ৭৫% ইহুদি, ১৫% মুসলিম, ২.১% খ্রিস্টান, ১.৭% দ্রুজ। এর মধ্যে, জাতিগতভাবে, ২০.৯% আরব। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ শাসিত অংশে, প্রায় সবাই আরব। এর মধ্যে ৯২-৩% মুসলিম বাকীরা বেশিরভাগ খ্রিস্টান। সব মিলিয়ে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি জনগণের প্রায় অর্ধেক ইহুদি, বাকি অর্ধেক আরব মুসলিম ও খ্রিস্টান।

১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে বিজয়ের পর সমগ্র জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ কার্যত ইসরায়েলের।জেরুজালেম শহরের পূর্বাংশে পুরাতন জেরুজালেমে মুসলিমরা এখনো সংখ্যাগুরু।পশ্চিমে শিল্পায়িত জেরুজালেমে ইহুদিরা সংখ্যাগুরু। তবে, নতুন বসতি স্থাপনের মাধ্যমে পূর্ব-জেরুজালেমে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হরণ করার চেষ্টা চলছে। ইসরায়েল রাষ্ট্রটি জেরুজালেমকেই তাদের রাজধানী করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্বীকৃতি বিশ্বে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। ফিলিস্তিনী জনগণ, আরব বিশ্ব, মুসলিম বিশ্বসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ‘জেরুজালেমের ওপর ইসরায়েলের একচ্ছত্র অধিকার মানতে নারাজ। জেরুজালেমের অধিকার সংক্রান্ত ট্রাম্পের বিবৃতিকে কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র ব্যাতিত ব্যাতিত কেউ সমর্থন করে নি। এর অর্থ এই নয় যে, এই রাষ্ট্রগুলোর সবাই চায়, জেরুজালেমে ফিলিস্তিনের রাজধানী হোক। বেশীর ভাগ দেশ চায়, যুক্তিযুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ী সমাধান। কী সেই সমাধান, এবার আসব সেই আলোচনায়।

জেরুজালেম সমস্যার সমাধান কি?
জেরুজালেম সমস্যার সমাধান কি? এই প্রশ্ন অনেকের। আমারো দীর্ঘদিনের জিগ্যাসা, এই সমস্যার সমাধানটি। এর সমাধান নিয়ে গাদ্দাফি, সাদ্দাম হোসেন, ইয়াসির আরাফাত কম গবেষণা করেন নি। আমি তাঁদের তুলনায় নিতান্ত অপাংক্তেয়। তবুও, নিজের চিন্তা, নিজের পড়াশুনা, অনুধাবন, বিশ্লেষণ, গবেষণা করে একটি সমাধানযোগ্য উত্তর পেয়েছি।
কি সেই উত্তর?- যে প্রশ্নটা আমি অনেক আগে থেকেই করে আসছি। জেরুজালেমের অধিকার তাঁকেই দিতে হবে, আসলেই যে এই শহরটির প্রকৃত দাবিদার।

‘জেরুজালেম শহরটির অধিকার কার’ এই প্রশ্নটির উত্তর আমি বিভিন্নভাবে খোঁজার চেষ্টা করেছি। পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি।
প্রথম পরীক্ষণ ছিল‘প্রথম নির্মাতার পরম্পরাগত অধিকার’ অনুসারে জেরুজালেমের অধিকার নির্ণয়।

এই পরীক্ষণে একক কোন দাবিদার পাওয়া যায় না। রাজা দাউদের উত্তরসুরিতা দাবি করছে মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি সবাই। আবার, এই পরীক্ষণের রাজা দাউদ(আঃ) যে জেরুজালেমের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা এটাও নিশ্চিত নয়। অতএব, এই প্রশ্নের উত্তরে কোন একটি একক পক্ষকে জেরুজালেমের অধিকার প্রদান করা ন্যায়সঙ্গত নয়।

দ্বিতীয় পরীক্ষণ ছিল‘শেষ নির্মাতার পরম্পরাগত অধিকার’ থেকে জেরুজালেমের প্রকৃত দাবিদার নির্ণয়। এই প্রশ্নের উত্তরে পাওয়া যায়, পুরান জেরুজালেমের অধিকাংশ স্থাপনা মুসলিমদের। পশ্চিম জেরুজালেম ইহুদিরা পুনর্গঠন করে ফেলেছে। পুবেও বাড়িঘর বানাচ্ছে। শেষের হিসেব যদি করতে হয়, তবে ‘ইসরায়েল বলবে আর কিছুদিন সবুর করো, পুরো জেরুজালেমে আমাদের স্থাপনা বানিয়ে ফেলি’। কারণ, ইহুদিরা বিশ্বাস করে থাকে, ডোম অব রকের ওপর তৃতীয় এবং শেষ বারের মত সিনাগগ নির্মিত হবে। সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেই তারা এখনো ডোম অব রক চত্বরে প্রার্থনা করে না। বরং, তারা ‘ওয়েলিং ওয়াল’ এর পাশে প্রার্থনা করে, স্রষ্টা যেন তাদেরকে শীঘ্রই তৃতীয় সিনাগগ ও ‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’ বানানোর তৌফিক দেন।

এমতাবস্থায়, এই প্রশ্নটির উত্তরেও একক কোন দাবিদারকে নির্ণয় করা যায় না।

তৃতীয় পরীক্ষণ ছিল ধর্মীয় দাবির ন্যায়তা থেকেসঠিক দাবিদার বের করে আনা। এই পরীক্ষার পরীক্ষণ ফল বলছে, ধর্মীয়ভাবে তিনটি ধর্মের দাবিইযার যার নিজেদের অবস্থান থেকে সঠিক, কিন্তু অপরের জন্য ক্ষতিকর। এই পরীক্ষণ থেকে কোন পক্ষকেই আলাদাভাবে বাছাই করা যায় না।

চতুর্থ পরীক্ষণটি ছিল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় দাবির নায়্যতা থেকে সঠিক পক্ষ নির্বাচন। বিশ্লেষণ বলছে, ফিলিস্তিনি ভূমিতে ‘ইসরায়েল’ রাষ্ট্র স্থাপনই অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আবার, ফিলিস্তিনে ‘সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থাপন’ই আজ পর্যন্ত সম্ভব হয় নাই। ইতিহাস বলছে, পুরো এলাকাটিতে একেক সময় একেক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তবে, ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম, দ্রুজ; অ্যাসিরীয়, আরব, ইসরায়েলি, বেদুইন, নানা জাতি-ধর্মের মানুষ যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। জেরুজালেম শহরেও নানা জাতির বাস দীর্ঘ বছরের। এহেন পরিস্থিতিতে, রাষ্ট্র পাওয়ার অধিকার সকলের। মানবাধিকার পাওয়ার অধিকার সকলের। তাই যদি বলি, জেরুজালেম তাঁকে দাও, যে এর প্রকৃত দাবিদার, তাহলে এর উত্তর মিলবে, ‘জেরুজালেম মানবতাকে দাও, মানব সভ্যতাকে দাও, এর দাবিদার প্রত্যেকে’।

তবে, এর সমাধান কীভাবে করবো? প্রত্যেককে কীভাবে অধিকার দিতে হবে?
এর উত্তর, ‘প্রত্যককে নিয়ে বসতে হবে’।

author

রাজা আবুল কালাম আজাদ

Raja Abul Kalam Azad is a post-modern researcher, writer, journalist, environmental activist, and teacher. He completed his bachelor's and master's degrees in disaster management at the University of Dhaka. His various research articles have been published in reputed international journals. Currently, he is working as a teacher at a government school and serving as the coordinator of the Disaster Economics Unit of Disaster Perception, a Dhaka-based organization. He is the Secretary General of 'Muktatma Samiti' and one of the Members of the Independent Bangla Editorial Board.

এই ধরণের আরো...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial