বিতুর সংগ্রাম

বিতুর সংগ্রাম

বিতুকে বিচলিত মনে হচ্ছে। বাহির বাড়ি থেকে দৌড়ে এসে ধপাস করে বসে পড়ল চৌকাঠের উপর। দোরের বাম পাল্লার ওপাশে থাকা এলুমিনিউয়ামের জগটা ধরতে গিয়ে পানি পড়ে গেল খানিক। মাটির মেঝেতে কাদা হয়ে গেল। “ধুর…” নিজের প্রতি এ ব্যাঙ্গক্তির মধ্যেই ফুটে উঠল ছোটবেলায় মা মরা কিশোরী মেয়েটি কতটা দুঃখী।

বিতুর বাবা পোস্টমাস্টার নজাব শিকদার। বয়েসের ভারে করতে পারেন না কিছুই। জমিজমাও নেই দখিন বাড়ির পালানটা ছাড়া। মাসান্তে যে সম্মানির টাকাটা জোটে, তা দিয়ে কোনোমতে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটে বাপবেটির।

মাঝে মধ্যে সকাল বেলার চা খরচেও টান পড়ে নজাব শিকদারের। মাঝে মধ্যে দেখা যায়, বৃদ্ধ পোস্টমাস্টার সক্কাল সক্কাল মতালেবের চায়ের দোকানে বসে আছে, কিন্তু অর্ডার দিচ্ছে না। আত্মসম্মানী মানুষ তিনি, না খেয়ে দুদিন উপোষ থাকলেও কারো করুনা তিনি চান না।

মতালেব এটা বোঝে, তাই এরকম দেখলেই, বলে “কাহা, চা দেই, ট্যাহা পড়ে দিয়েন”। ১২ বছরের ছেলের কাছে ঋণী হতেও সঙ্কোচ লাগে তাঁর। কখনো বলে “দেও এক কাপ”, কখনো উত্তর করে “নারে বা, এহন চা টা খাইবার মল্লাইতেচে না, পড়ে খাব রাহো”।

আজ উল্লাপাড়া গেছে নজাব শিকদার। উদ্দেশ্য একটা বোরখার কাপড় কিনবে মেয়ের জন্য।

বিতু এবার এসএসসি পাশ করেছে। কলেজে ভর্তি হতে হবে। ওর বেশি কাপড়-চোপড় নাই। বোরখা পড়ে গেলে একই কাপড় প্রত্যেকদিন পড়লেও কেউ দেখবে না। বোরখার নিচের জামাটা দুবছরের পুরনো হলেও কারো চোখে পড়বে না।

বাবা চলে যাওয়ার পর একা থাকতে ভাল লাগছিল না বিতুর। প্রিয়তমা বান্ধবী শিলাদের বাড়ি রওনা দিল সে। দুটো মুলোর পালান, শেখবাড়ির পুকুরপাড় আর ১৯৭১ এ ফেলে যাওয়া হিন্দুদের খালীপাড়া পারি দিলেই শিলাদের বড় বাড়ি।

হেঁটে যেতে ১৫ মিনিটের পথ। এ পথে লোক জাতায়াতের চল খুব একটা নাই। শেখ বাড়ির পুকুরপাড়টা তো গুল্মলতায় ঘেরা: সাপ-খোপের চলাচল আছে। আর খালী পাড়ায় ভুত দেখার গল্প শোনে নি, এরকম বালেগ-বালেগা এ গাঁয়ে একজনও নেই। সে কথা চিন্তা করে একটু ভয়ভয়ও লাগছিল বিতুর। সে ভাবল, ওদিকটায় গিয়ে দাড়িয়ে থাকবে, কোন লোকজনের সাক্ষাৎ মিললে তার পিছুপিছু পারি দিবে খালীপাড়া।

সে মোতাবেক শেখ বাড়ির পুকুরপাড়ে অপেক্ষা করতে লাগল বিতু। হঠাৎ কলমিঝোপের ভিতর থেকে “ছরররররর” করে শব্দ হল। ভয়ে লাফিয়ে উঠল সে। দৌড়ে দূরে যেতে যেতে দেখল, একটা গুইসাপ পানিতে সাঁতরাচ্ছে। তেমন ভয়ের কিছু নয়। কিন্তু; গত শনিবার এখান থেকে রবিউলকে সাপে কামড়েছে সেই কথা মনে করে ও আর দাঁড়াতে পারল না এখানে। খালিপাড়ার দিকে হাটা দিল একাই।

একটু এগিয়েই সে দেখতে পেল ৪০ বছরের রহমত আলী বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে গিয়েছিল। মনে মনে রেগে যায় বিতু। দেশব্যাপী স্যানিটেশনের জন্য কত কিছুই না হল, তবু কিছু মানুষের বদ অভ্যাসের জন্য শতভাগ স্যানিটেশন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

বিতু জানে, এ গাঁয়ে সবার বাড়িতে ল্যাট্রিন আছে, রহমত আলির বাড়িতেও, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ফ্রি দিয়েছে। তারপর কয়েকজন মানুষের জন্য খালিপাড়ার রাস্তায় হাটা যায় না। রাস্তার অদূরে বাঁশঝাড় থেকে ভেসে আসে গুর গন্ধ। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গন্ধ।

হরেক রকমের দুর্গন্ধের দমকা বাতাস মুহূর্তে মেজাজ বিগড়ে দেয়। কারন, বাঁশঝাড়ের উদম ময়দানে উন্মুক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানান রকমের গু, নানান জনের এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, দশ দিনের শুকনো গু, আধা শুকনো গু, পাতলা গু, আমাশয় ওয়ালা গু, পাতলা পায়খানা রোগীর গু। ভাবতেই ঘেন্না লাগে বিতুর।

“ইসস… মূর্খ গুলার ঘিন্না-লজ্জা নাই” বিরবিরেই বলেই ফেলে বিতু।

“উহ, রহমত কাকা শুনেই ফেলল নাকি!!” ভেবে দুপা পিছিয়ে যায় সে।

“এ বিতু, এহেনে কিরে? কিকামে আচু?” রহমত ডাকে।

মৃদু পায়ে এগিয়ে যায় বিতু। মনে জমানো ভয়। “কি যে বলে রহমত কাকা। ধমকই দেয় নাকি।” রহমতও এগোয় ধীর পায়ে।

নিকটে আসতেই রহমত নিচু গলায় বলে “ এ গেদি লে হরি, তোরও বাল্লাগবিনি আমারও”………… বলতে বলতেই বিতুর হাতটা চেপে ধরে রহমত।

বিতু এক ঝটকায় হাতটা টান দিয়েই দে দৌড়। এক দৌড়ে এসে বাড়ি পৌঁছে। পিছু ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে হয় না তার।

author

রাজা আবুল কালাম আজাদ

Raja Abul Kalam Azad is a post-modern researcher, writer, journalist, environmental activist, and teacher. He completed his bachelor's and master's degrees in disaster management at the University of Dhaka. His various research articles have been published in reputed international journals. Currently, he is working as a teacher at a government school and serving as the coordinator of the Disaster Economics Unit of Disaster Perception, a Dhaka-based organization. He is the Secretary General of 'Muktatma Samiti' and one of the Members of the Independent Bangla Editorial Board.

এই ধরণের আরো...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial