বাংলাদেশে যৌনসন্ত্রাস: ধরণ, কারণ ও প্রতিকার

শিক্ষা, প্রযুক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাপক বিকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে প্রগতির পথে, তারই বিপরীতে বেখাপ্পাভাবে আবির্ভূত হচ্ছে কিছু সামাজিক সমস্যা। এর মধ্যে যৌন সন্ত্রাস অন্যতম। শিশুধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, চলন্তবাসে যৌন নির্যাতন, স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, হাটে, বাজারে, রাস্তায় বিভিন্নপ্রকারের যৌন নির্যাতন-যৌন অপরাধের কথা শুনতে শুনতে আমাদের কিছুটা কানসহা হয়ে গেছে। এসব খবর এখন আর আগের মত নাড়া দেয় না। অথবা, একটা খবর অনুভুতিকে ব্যাপক করে নাড়া দিতেই আরেকটা খবর সেই আবেগের স্থান দখল করে নেয়, হঠাৎ করেই। সেকারণেই হয়ত টের পাই না, সমস্যাটা কতটা প্রকট! এসব ঘটনার ভুক্তভোগী এবং তার নিকটাত্বীয়রা অবশ্য ভালো করেই অনুধাবন করতে পারেন। ‘কী যাতনা বিষে, বুঝতে পারে সে, একদা আশীবিষে দংশেছে যারে’।

বাংলাদেশে যৌন অপরাধের পরিসংখ্যান
যৌন নিপীড়ন ও যৌন সন্ত্রাস একটা সামাজিক ব্যাধি। বাংলাদেশে (ও আমাদের প্রতিবেশী ভারতে) এই ব্যাধিটি অধিকতর প্রকট। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই ১ হাজারেরও অধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে (ফারহানা পারভীন। ২০১৭, জানুয়ারি ৮)।

এনডিটিভিতে প্রকাশিত স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক তপন মাহমুদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে ৭২৪ জন নারী ধর্ষিত হবার ঘটনা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি। আর ২০১৫ সালে সারাদেশে ২৩৬টি ধর্ষণের রেকর্ড করা হয় । এর মধ্যে ২৩২ জন নারী ও ৪ জন পুরুষ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন (তপন মাহমুদ। ১৩ মে ২০১৭)।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের প্রথম দুই মাসে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১২০টি ।
জাতীয় মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৪ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩০ জনকে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৬ জন। ২০১৩ সালে ধর্ষণ হয়েছেন ১০৭ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৬ জনকে এবং গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৫ জন। ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫৩ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৮ জনকে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৬ জন (জয়শ্রী ভাদুড়ী। ২০১৭, সেপ্টেম্বর ১)।
এসকল প্রতিবেদন থেকে প্রতীয়মান হয়, প্রতি বছর, জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা।

বাংলাদেশের ধর্ষণ পরিসংখ্যান (২০১২-২০১৭):

সাল

প্রতিমাসে ধর্ষণের হার

২০১২

২০১৩

২০১৪

১৩

২০১৫

২০

২০১৬

৬০

২০১৭

৬০

(তথ্যসূত্রঃ সেকেন্ডারি উৎস থেকে লেখক কর্তৃক  সংগৃহীত)

শুধু ধর্ষণ নয়, যৌন হয়রানী, লাঞ্ছনা, নির্যাতন ও নানা রকমের যৌন অপরাধের ঘটনাও ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলছে। সেই সাথে বদলে যাচ্ছে যৌন অপরাধের ধরণও। অপরাধের অবয়বে, ঘটনায়, নেপথ্যে যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্র্যাক স্কুল অব ল’ আয়োজিত ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অ্যান্ড রাইটস অব উইমেন ইন পাবলিক প্লেসেস’ শীর্ষক সেমিনারে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ জানায়, গত চার বছরে যৌন-হয়রানির শিকার হয়ে ৯৯ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০ জনই ০-৬ বছরের শিশু। আর ১৪৪ জন ছিল ৭-১২ বছরের শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জনকে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৭ জন। নিত্য নতুন বেড়েই চলছে বীভৎস বীভৎস অপরাধকাণ্ড।

নতুন মাত্রার যৌন অপরাধঃ ধরণ ও স্বরুপ
বছর কয়েক হলো, উপমহাদেশে আমদানী ঘটছে বিচিত্র ধরণের যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা। যা মানুষ আগে শোনে নি, এমন সব কাণ্ড ঘটছে দিনকে দিন। ২০১৫ সালে ১৪ এপ্রিল, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ঘটে গেলো এক অবাক করা কাণ্ড। একদল উন্মত্ত তরুণ হায়েনার মত ঝাপিয়ে পড়ল তরুণীদের ওপর।

২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের শুভেচ্ছা পরিবহনের চলন্ত একটি বাসে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ২০১৫ সালের ১২ মে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে চলন্ত বাসে এক পোশাক কর্মীকে ধর্ষণ করে ফেলে দেন বাসচালক ও চালকের সহকারী। ঢাকায় এক গারো তরুণীকে চলন্ত মাইক্রোবাসে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি বরিশালে সেবা পরিবহনের একটি বাসে দুই বোনকে ধর্ষণ করেন পাঁচ পরিবহন কর্মী। ওই বছরের ১ এপ্রিল টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী থেকে ঢাকাগামী বিনিময় পরিবহনের একটি বাসে ধর্ষণের শিকার হন এক পোশাক কর্মী। ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ময়মনসিংহের নান্দাইলে একটি বাসে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে বাসচালকসহ তিন পরিবহন কর্মী। বাসচালককে ঘটনাস্থল থেকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেন মানুষ। এরই কিছুদিন পর টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে ধর্ষণ টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে পরিবহন শ্রমিকরা মিলে নারী যাত্রীকে ধর্ষণ ও পরবর্তীতে হত্যা করে লাশ ফেলে দেয় (জয়শ্রী ভাদুড়ী। ২০১৭, সেপ্টেম্বর ১)।

ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, এমন বীভৎস ঘটনার মধ্যেই আরেক কাণ্ড শোনা গেলো ২০১৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে। অনেক নারী অভিযোগ করতে লাগলেন, গণপরিবহণে কে বা কারা তাদের পোশাক কেটে দিচ্ছে(আহমেদ আল জুবাইর। ২০১৭, নভেম্বর ৮)। যৌন অপরাধীদের কি আদিখ্যেতা! কি সৃজনশীলতা!

এবার ২০১৮ সালের ৭ মার্চ ঘটে গেলো আরেক হৃদয় বিদারক কাণ্ড। একাধিক নারী এদিন দাবি করেন, ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে, মলেস্টেশন করা হয়েছে(মুহাম্মদ সাইদুজ্জামান আহাদ। ২০১৮, মার্চ ৮)। এই ঘটনা নিয়ে আবার করা হচ্ছে পাল্টাপালটি রাজনীতি। আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘দল এর দায়িত্ব নেবে না। কারণ, ঘটনা ঘটেছে সভাস্থলের বাইরে।’ বিরোধীরা বলছে, ‘এ ঘটনা সরকারী দলের নেতাকর্মীর চরম নৈতিকতার অবক্ষ্যয়ের বহিঃপ্রকাশ’। সরকারের কেউ কেউ দাবি করছেন, ‘বিরোধী অনুপ্রবেশকারীরাই এর নেপথ্যে’(সিরিজ নারী লাঞ্ছনার ৯ মার্চ, ২০১৮ ) ।

আমি বলবো, ঘটনা আওয়ামীলীগ ঘটাক আর অনুপ্রবেশকারী ঘটাক, অপরাধীরা বাঙালি। তারা এই দেশের নাগরিক। একজন বাঙালি হয়ে, বাঙালি জাতির মুক্তির মন্ত্র ‘জয় বাংলা’ বলে অপবিত্র কোন কাজ করবে, সেটা সত্যি ভয়ঙ্কর, ভয়াবহ, মারাত্মক। এটা একই সাথে ‘যৌন অপরাধ’ ও ‘দেশদ্রোহিতা’। এই ঘটনা প্রমাণ করে, দিনকে দিন মানুষ কেমন উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। সমাজের এক বৃহত্তর অংশের মননে ধরেছে পচন, যা আঘাত করছে মানুষের মূল্যবোধকে, গভীর থেকে, নেতিবাচক ডিরেকশনে।

যৌন সন্ত্রাস দূরীকরণে ইতোমধ্যে গৃহীত উদ্যোগ
বাংলাদেশে যৌন-হয়রানি রোধে একটি নীতিমালা করে দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেখানে আদালত রায় দেন, ‘মেয়েদের উত্যক্ত করা, তাকিয়ে থাকা, ই-মেইল বা ফোনে বিরক্ত করা, এমনকী রাস্তায় অচেনা কাউকে ‘সুন্দরী’ বলা– এসবই যৌন-হয়রানির মধ্যে পড়বে’।

হাইকোর্টের জারি করা নীতিমালায় বলা হয়েছিল, ‘যতদিন পর্যন্ত যৌন-হয়রানির কোনো আইন পাস না হবে ততদিন পর্যন্ত হাইকোর্টের এই নীতিমালা অনুসরণ করা হবে। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ সংশোধনসহ, ‘যৌন-হয়রানি প্রতিরোধ খসড়া আইন ২০১০’ তৈরি করা হয় (এম এম খালেকুজ্জামান ২০১৬, আগস্ট ২২)।

২০১০ সালের ২৫ আগস্ট আইন কমিশন একটি খসড়া আইন তৈরি করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে ‘যৌন-হয়রানি প্রতিরোধ আইন-২০১০’ (প্রস্তাবিত) নামের আইনটিতে মোট ২১টি ধারা রয়েছে। এ ছাড়া লঘু ও গুরুতর অপরাধ আলাদাভাবে চিহ্নিত করে একটি তফসিল সংযুক্ত রয়েছে। কিন্তু সেটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি (মহিলা বিষয়ক মন্ত্রনালয়।২০১৭, জানুয়ারী ৩১)।

এসব আইন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পুরো প্রক্রিয়া জুড়েই গ্রহণ করা হয়েছে চিরাচরিত পদ্ধতি। অপরাধ হলে, কোন অপরাধের শাস্তি কী হবে, সেটা নিয়েই মূলত আলোকপাত করা হয়েছে এগুলোতে। অপরাধ যেন আর সঙ্ঘটিত না হয়, তার জন্য বা অপরাধ সংঘটনের মাত্রা কমানোর জন্য কোন সরকারী উদ্যোগ আমার চোখে পরেনি।

তবে, যৌন-অপরাধ প্রতিকারে কিছু এনজিও ও সুশীল সমাজ অল্পবিস্তর ‘সচেতনতা কর্মসূচী’ গ্রহণ করেছে। উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে, গত ২৮ নভেম্বর, ২০১৭, ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে নারীর যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে পোস্টার প্রদর্শনী করছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ (যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০১৭, নভেম্বর ২৮) ।

গত ১২ মার্চ, ২০১৭, নরসিংদীতে যৌন হয়রানি, সাইবার বুলিং এবং বাল্য বিয়ে প্রতিকার ও প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে সংবাদ মাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে মেজনিন কর্মসূচী পরিচিতি ও মতবিনিময় সভা আয়োজন করেছে ব্র্যাক (নরসিংদীতে যৌন হয়রানি ২০১৭, মার্চ ১২) ।

ক্রমবর্ধমান যৌন অপরাধঃ বিজ্ঞানভিত্তিক কারণ অনুসন্ধান
ক্রমবর্ধমান এইসব যৌন অপরাধের হার এবং যৌন অপরাধের নিত্য নতুন স্টাইল আমদানি থেকে বোঝা যায়, এই সমস্যাটার উদ্ভব সমাজের অনেক গভীর থেকে। সমস্যাটির একটি অনেক নানাবিধ কারণ আছে। তবে, অপরাধের ধরণ পরিবর্তন ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে অনুমান করা যায়, সমস্যাটির সংঘটনে অভিনব কিছু কারণ থাকতে পারে, যেগুলো দূর করতে পারলে দূর করা সম্ভব, এই মহামারী সামাজিক ব্যাধি_ যৌনসন্ত্রাসকে।

যৌণ অপরাধের মত এক সামাজিক ব্যাধির সঠিক, সময়োপযোগী ও যথোপযুক্ত প্রতিকার ব্যাবস্থা বের করতে হলে তাই দরকার বিজ্ঞানভিত্তিক, গবেষণামূলক কিছু সিদ্ধান্ত। এই অপরাধের কারণ খুঁজতে হবে সামাজিক বাস্তবতার প্রত্যেকটি পরতে থেকে।
এরই লক্ষ্যে, দিনা এম সিদ্দিকী (২০০৩) এর একটি গবেষণা উল্লেখযোগ্য। তারThe Sexual Harassment of Industrial Workers: Strategies for Intervention in the Workplace and Beyond’শীর্ষক গবেষণাপত্রটিতে তিনি নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে যৌননিগ্রহের কারণ খুঁজেছেন যৌন নিগ্রহ সমস্যার মৌলিক কারণ হিসেবে তিনি শনাক্ত করতে চেয়েছেন, সমাজে নারী ও পুরুষের ক্ষমতার বৈষম্যকে। তার ভাষায়,‘harassment is unequal power relations in society as a whole’ Siddiqi, D. M. (2003).

এই গবেষণাটির মূল দুর্বলতার দিকটি হল, যৌন নিগ্রহের যেসব ঘটনা বিশ্লেষণ তিনি করেছেন, তার প্রতিটি ঘটনা (case study) নিয়েছেন নারীদের থেকে। গবেষণাটির সমগ্র ক্ষেত্র জুড়ে ছিল নারী। গবেষণাপত্রটিতে পুরুষদের ভঙ্গিকে খাটো করে দেখানো হয়েছে। কোন মানসিক-সামাজিক পরিস্থিতে একজন পুরুষ যৌন নিগ্রহের মত কাজে জড়িয়ে পড়ে তা উদ্ঘাতনের কোন প্রচেষ্টা এই গবেষণাটিতে নেই।

লরি এল. হেইজ (২০০৩) তার গবেশনায় জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতার কয়েকটি মৌলিক কারণ বের করেছেন। এগুলোকে তিনি মোটা দাগে ৩টি ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথাঃ ব্যাক্তিগত, পরিস্থিতিগত ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক। এই তিনটি কারণকে তিনি তার ‘ফ্রেমওয়ার্ক অব ভাইলন্স’ মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, নারীরা সহিংসতার স্বীকার হয় মূলত, নারী ও পুরুষ উভয়েরই মনস্তাত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থানগত কারণে। আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের ওপর কৃত এই গবেষণায় সেই সমাজের প্রেক্ষিতে সহিংসতার কিছু কারণ ব্যাখ্যা করা হয়।

নারী কেন ছোটবেলা থেকেই মনস্তাত্বিকভাবে পুরুষের আধিপত্য মেনে আসছে, পুরুষ কেন ছোটবেলা থেকেই কর্তৃত্বপরায়ণ, তার ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, মনসামাজিক ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। সেই ব্যাখ্যার আলোকেই কিছু নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান বাতলাবার প্রয়াস পেয়েছেন। পুরুষরা কেন নারীদের ওপর আধিপত্য করতে চায়, তার কারণ ব্যাখ্যায় লরি হেইজ বলেন, ‘ছেলেশিশুটি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসে তার বাবা মায়ের ওপর আধিপত্য করছে, তাই সে বড় হয়ে স্ত্রীর ওপরও আধিপত্য করতে চায়।’ (হেইজ, ২০০৩: ২৬৭)

কিন্তু, আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য হলো, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এরকম কোন গবেষণা নেই। লরি হেইজ যে কারণগুলো বের করেছেন, সেগুলো সত্যিকার অর্থেই আমাদের সমাজের ধ্যান ধারনা, চেতনা- বিশ্বাস ও সামাজিক গতিপ্রকৃতির সাথে সঙ্গতিবিহীন। তাই, আমাদের সেইসব কারণ ও সমাধানও আমাদের দেশের ক্ষেত্রে হুবহু নকলযোগ্য নয়।

তাছাড়া, আমাদের সমাজে যৌণ অপরাধের নতুন যেসব উপসর্গ যোগ হচ্ছে, তার বিন্দুবিসর্গের উপস্থিতি নেই আমেরিকায়। আমাদের দেশের ‘যৌন নিগ্রহ’ সমস্যার স্বরুপ আলাদা, এর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্বিক পরিস্থিতি আলাদা। ফলে, এদেশে একটি সমন্বিত গবেষণা প্রয়োজন, যার দ্বারা উদ্ঘাতন করা যাবে, এদেশের পুরুষেরা কেন হঠাৎ করে এমন অদ্ভুত রকমের সহিংস হয়ে উঠছে। এর ব্যাপারে নারীদের দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পুরুষের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্ত্বাত্বিক ও মানসিক পরিস্থিতিও বিচার বিশ্লেষণের আওতায় আনতে হবে।

যৌন সন্ত্রাসের নাগাল ধরতে করণীয়
প্রত্যেকটি রোগ দমন করতে দুই ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। যথা:
১।প্রতিকার ও
২। প্রতিরোধ
প্রতিকার মানে হল- কিছু আক্রান্ত হয়ে গেলে ঘুরে দাঁড়ানো। তার প্রতিবিধান করা। আর প্রতিরোধ হল- আক্রান্ত হওয়ার উপক্রম, কিন্তু এখনো হয়নি- এমতাবস্থায় রুখে দাঁড়ানো। অর্থাৎ, আগে প্রতিরোধ করতে হয়। এরপরও আক্রমণ থামানো না গেলে তথা আক্রান্ত হয়ে গেলে তখন প্রতিকার করতে হয়। আরো সহজ করে বলতে গেলে, কোনো কিছু ঘটে যাওয়ার পর তা অনুকূলে নেই, প্রতিকুলুতে আনার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়ার হয় তাই প্রতিকার। আর- কোনো কিছু ঘটবে, যা ভালো কিছু নয় সেটা যেনো না ঘটে তার জন্য যে কাজ করা হয় তাই প্রতিরোধ।

আমাদের ক্রমবর্ধমান যৌন অপরাধের প্রতিকারে বেশ কিছু ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আইন-কানুন, নীতিমালা এগুলো প্রতিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু, প্রতিরোধের জন্য যেসব কার্যক্রম দরকার, তার প্রায় কোনটিই নেই। অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে, এমন পুরুষরা নিজেরাই যেন যৌন অপরাধের দিকে না ঝুঁকতে পারে, সেজন্য সচেতনতামূলক ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম যেমন দরকার, পাশাপাশি, যে আর্থ-সামাজিক, মনস্তাত্বিক প্রেক্ষাপটে একজন পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে, সেটারও নিরসন করা দরকার। একইভাবে, পুরুষের এই বিদ্যমান মনো-সামাজিক পরিস্থিতি থেকে নিজেদের নিরাপদ করতে নারীর করণীয় কী সেটাও বের করা দরকার। এই সমস্ত প্রতিরোধ ব্যাবস্থাসমুহ মূলত কৌশলগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও গবেষণাধর্মী। যৌন অপরাধের প্রতিরোধে নারী ও পুরুষকে কীভাবে জাগ্রত করা যায়, এজন্য দরকার উভয়ের অংশগ্রহনে কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচী, সচেতনতা, ও অর্থনৈতিক-সামাজিক সংস্কার। একজন পুরুষ কোন প্রেক্ষাপটে ধর্ষক হয়ে ওঠে, সেই প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণপূর্বক, তার অনুকূলে কিছু নিরসনমূলক ব্যাবস্থা গ্রহণও জরুরী। এই সমস্ত কর্মসূচী কেমন হওয়া উচিত, তা বের করতে এই সমাজের প্রেক্ষাপটে কিছু বিশ্লেষনাত্বক গবেষণা। (চলবে)

তথ্যসুত্রঃ
১। ফারহানা পারভীন। (২০১৭, জানুয়ারি ৮)। এক বছরে বাংলাদেশে ১ হাজারেরও বেশি ধর্ষণ | বিবিসি বাংলা । retrieved from http://www.bbc.com/bengali/news-38548834
২। তপন মাহমুদ। (১৩ মে ২০১৭)। ধর্ষণ বাড়ছে, প্রতিকার কী? | এনডিটিভি Retrieved from http://www.ntvbd.com/opinion/130013/ধর্ষণ-বাড়ছে-প্রতিকার-কী \
৩। জয়শ্রী ভাদুড়ী। (২০১৭, সেপ্টেম্বর ১)। বাড়ছে ধর্ষণ বাড়ছে উদ্বেগ | বাংলাদেশ প্রতিদিন। retrieved from http://www.bd-pratidin.com/last-page/2017/09/01/260829
৪। আহমেদ আল জুবাইর। (২০১৭, নভেম্বর ৮)। বাসে নারীদের পোশাক কেটে দেয় কে??। | ইনডিপেনডেন্ট বাংলা । Retrieved from http://www.independentbangla.com/পোশা-কেটে/
৫। মুহাম্মদ সাইদুজ্জামান আহাদ (২০১৮, মার্চ ৮)। ‘জয় বাংলা বলে যারা মেয়েদের মলেস্ট করে, তাদের দেশে আমি থাকবো না!’| এগিয়ে চলো। retrieved from http://egiye-cholo.com/joy-bangla-molest/
৬। সিরিজ নারী লাঞ্ছনার পরও আওয়ামী নেতাদের টনক নড়ছে না (৯ মার্চ, ২০১৮) | কালের কণ্ঠ । retrieved from http://www.kalerkantho.com/online/national/2018/03/09/611357
http://egiye-cholo.com/joy-bangla-molest/
৭। এম এম খালেকুজ্জামান (২০১৬, আগস্ট ২২)। যৌন-সন্ত্রাস রোধে নীতিমালা নয়, আইন চাই | bdnews24.com. Retrieved from https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/36206
৮। মহিলা বিষয়ক মন্ত্রনালয়(২০১৭, জানুয়ারী ৩১)। কর্মস্থলে যৌন হয়রানী বন্ধের লক্ষ্যে মহামান্য হাইকোর্ট প্রদত্ত নীতিমালা সম্পর্কে অবহিতকরণ কর্মশালায় অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে । ঢাকা। Retrieved from www.dwa.gov.bd/site/notices/b24801a5-3ff8-4eb3-a6ff-21efe11428e0/কর্মস্থলে-যৌন-হয়রানী-বন্ধের-লক্ষ্যে-মহামান্য-হাইকোর্ট-প্রদত্ত-নীতিমালা-সম্পর্কে-অবহিতকরণ-কর্মশালায়-অংশগ্রহণ-প্রসঙ্গে
৯। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ঢাবিতে প্রদর্শনী (২০১৭, নভেম্বর ২৮) | Banglanews24.com. Retrieved from http://www.banglanews24.com/education/news/bd/620604.details
১০। নরসিংদীতে যৌন হয়রানি, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ব্র্যাকের মতবিনিময় সভা (২০১৭, মার্চ ১২) | দৈনিক জনকণ্ঠ । retrieved from http://web.dailyjanakantha.com/details/article/254867/নরসিংদীতে-যৌন-হয়রানি-বাল্যবিয়ে-প্রতিরোধে-ব্র্যাকের-মতবিনিময়-সভা/
১১। Siddiqi, D. M. (2003). The Sexual Harassment of Industrial Workers: Strategies for Intervention in the Workplace and Beyond. Dhaka: Center for Policy Dialogue. Retrieved from http://cpd.org.bd/pub_attach/unfpa26.pdf
১২। Heise, L. L. (2003). Violence Against Women: An Integrated, Ecological Framework. Retrieved from http://gbvaor.net/wp-content/uploads/2012/10/Violence-Against-Women-An-Integrated-Ecological-Framework-Heise-1998.pdf

 

author

রাজা আবুল কালাম আজাদ

Raja Abul Kalam Azad is a post-modern researcher, writer, journalist, environmental activist, and teacher. He completed his bachelor's and master's degrees in disaster management at the University of Dhaka. His various research articles have been published in reputed international journals. Currently, he is working as a teacher at a government school and serving as the coordinator of the Disaster Economics Unit of Disaster Perception, a Dhaka-based organization. He is the Secretary General of 'Muktatma Samiti' and one of the Members of the Independent Bangla Editorial Board.

এই ধরণের আরো...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial