বাংলাদেশের পরিচয় অনুসন্ধান

পৃথিবীর প্রথম যুগে
আদম-হাওয়ার যোগে
প্রথম এসেছিল যে মুক্ত মানবসন্তান,
শুধুই ‘মানুষ’ ছিল তার জাতি-নাম-সম্মান;
কোনো মানুষ ছিল না তার দাস,
কোনো মানুষের দাসত্বের রাজত্বে ছিল না তার বসবাস।
শিকারি-ফলাহারি মানুষ গোত্র ও দলে বিভক্ত হলো,
পৃথিবীর তলে, জলে ও স্থলে ছড়িয়ে পড়ল।
জলবায়ুর তফাতে,
খাদ্যশৃঙ্খলের ঘাতে-প্রতিঘাতে,
প্রতি প্রভাতে মানুষের চেহারা বদলে যেতে লাগল।
মানুষেরই মাঝে তৈরি হলো:
নানান গোত্র, দল, উপদল,
ভৌগোলিক বিভক্তিতে
মানুষ বিভক্ত হতে লাগলো জাতিতে জাতিতে।
ধীরে ধীরে কৃষিকাজের জেরে,
থিতু গেড়ে
বসল মানুষ,
এক ভিটায় ক্রমাদিক্রম অনেক পুরুষ,
এভাবেই গড়ে উঠল নগর-বন্দর-সভ্যতা!
সভ্যতার অসভ্যতায় মানুষ হারাল স্বাধীনতাÑ
এক মানুষ অপর মানুষের অধীনস্ত হলোÑ
দাস হলো,
গোত্রগুলো ফুলে ফেঁপে উঠল,
রাজ্য থেকে সা¤্রাজ্য গড়ে উঠল।
বিলাসী রাজার খায়েশ মেটাতে
প্রজারা খাটে রাতে-বিরাতে।
রাজার হুকুম তামিল করাতে,
জমিদার-সামন্তরা চাবুক আর শিকল হাতে,
ঘুড়ে বেড়াতে থাকে নগরে ও পল্লিতে।
হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর,
মাঝখানে নদী, খাল, সমতল, পাহাড়, ঢিবি, প্রান্তর।
‘নেগ্রিটো’ বলে এক মনুষ্যজাতে
এইখানেতে এসে ঘর পাতে।
এরপর অস্ট্রালয়েডরা এসে,
নেগ্রিটোদেরই পাশে
পাতে সংসার:
বাংলার পাহাড়-বন-নদী-উপক‚ল-পাথার।
এরপর দক্ষিণ-পশ্চিম হতে
তামিল আর ভেড্ডিড জন¯্রােতে
জঙ্গলমহল আর সুন্দরবনের পথে
মানুষ আসে এইখানেতে।
হিমালয় থেকে সাগরের তট
গড়ে ওঠে পুÐ্র, বঙ্গ, হরিকেল, সুহ্ম, গৌড়, সমতটÑ
নানা যুগে বহু ভ‚গোলে
বহু জনপদ গড়ে ওঠে এই অঞ্চলে;
নানাজাতের মানুষের মিশেলে একাকার,
এই বাংলার পথ-ঘাট-পাহাড়-পাথার।
সিন্ধু-গঙ্গার পথ ধরে,
সাদাটে-তামাটে আর্যরা আসে চলনবিলের ভেতরে।
জনপদগুলো জয় করে,
মহাসামন্ত শশাঙ্ক এক রাজত্ব গড়ে।
পাল রাজারা চার শত বছর ধরে,
গৌতম বুদ্ধের শিষ্যদের সাথে করে
এই বাংলায় ‘রাজত্ব’ কায়েম করে,
সহজিয়া বৌদ্ধ ঋষিরা চর্যাগীতের আকারে
সেকালের বাংলার চিত্রধারণ করে:
টালত মোর ঘর, নাহি পড়বেশি,
হাড়িত ভাত নাহি, নিতি আবেশী।
কৃষাণেরা ফসল ফলায়;
মাঝি, শিকারি, কাঠুরে, তাঁতি, জেলে,
ডোম, কাপালি আর চÐালের ছেলে,
রাজাদের কর দিয়ে কোনোমতে জীবন চালায়।
কর্ণাটক থেকে সেনেরা এসে,
পাল রাজাদের হটিয়ে সিংহাসনে বসে।
বৌদ্ধ ঋষিরা পালিয়ে যায়,
নেপালে, তিব্বতে, আসামে, আরাকানে, বার্মায়,
ব্রাহ্মণ শাসনে সনাতন ধর্ম নবরূপ পায় বাংলায়।
আফগানিস্তান থেকে তুর্কি মুসলমান,
ঘোড়ায় চড়ে উড়ে এসে তখতে বসে হলো সুলতান।
আরব-ইরান-তুরান
থেকে পির-শেখ-মাশায়েখগণ আনলেন নয়া জীবনবিধান:
সব মানুষ সমান আর লা শারিকাল্লাহ-তে ইমান।
বাংলায় নবসুর দিল ইসলাম:
“মকদম সেখ সহজালাল তব পাদে করোঁ পরনাম”
শেখদের শুভোদয়ে
বর্ণপ্রথার পরাজয়ে
শুদ্র আর বৌদ্ধদের নবজীবনের নবোদয়ে
নতুন স্বপ্নে হলায়ুধ মিশ্ররা গান গায়;
কলিমা জল্লাল আর নিরঞ্জনের রুশ্মায়
রামাই পÐিত তুলে ধরে
নতুন করে নতুন সুরে
¯্রষ্টার নতুন স্তবগান।
শাহ-ই-বাঙ্গালাহ উপাধি নেন মুসলমান সুলতান।
নেগ্রিটো-অস্ট্রিক-আর্য-আরব-তুর্কি-মঙ্গোল নানা জাতি,
পাশাপাশি ঘর বেঁধে
একঘরে খেতে খেতে
গড়ে তোলে এক ভাষা, এক কৃষ্টি, এক সংস্কৃতি।
সুলতানের রাজত্বে
ইসলামের সাম্যের মাহত্বে
দলে দলে
আর্য-অনার্য, শূদ্র-বৌদ্ধ, আরব-ইরানি-মঙ্গলে
চলে আসে ইসলামের ছায়াতলে,
আন্তঃসাম্প্রদায়িক বিবাহের ফলে,
বাঙালির উদ্ভব হয়: সকলের মিশেলে;
পুÐ্র,ি গৌড়ি, রাঢ়ি, বঙ্গালি, হরিকেলিÑ
সকলের মিশেলে জন্ম নেয় কসমোপলিটান বাঙালি।
এক ভাষায় কথা কয়,
একসুরে গান গায়,
এক থালায় ভাত খায়,
এক রাজাকে কর দেয়,
আর একই পেয়াদার পিটুনি খায়।
মুসলমান সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায়
মহাভারত-মহাভাগবদ গীতা তর্জমা করে বাংলায়
মালাধর বসু, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দীরা;
শাহ মুহম্মদ সগির, ফকির গরিবুল্লাহ প্রমুখ মুসলমান কবিরা
পৌরাণিক গল্প ছেড়ে-
বাংলায় প্রথম রচনা করে
মানুষের গানÑ
রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান।
গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু-মুসলমান,
সমস্বরে গেয়ে সমসুরের ওঠে গান:
নাথ-মর্সিয়া-শের-কবিগান-বাউলগান।
চÐীদাস তাঁর রচনায় দিলেন ঠাঁই:
“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”
ভারতচন্দ্র বাঁজাইলেন বাঁশী:
জন্মভ‚মি জননী স্বর্গের গরিয়সী।
রাজা যায় সুলতান আসে,
সুলতান যায় নওয়াব আসে,
জনতার ভালে কেবলি ভাসে:
জন্মই শ্রমের জন্য,
প্রজার শ্রমেই রাজার অন্ন।
রাজাদের পুষতে পুষতে প্রজাদের কতকাল চলে গেলো;
জ্ঞানদাস বলে গেলো:
“সুখের লাগিয়া এঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেলো।”
এমনি করিয়া করিয়া
মোগল-পাঠান হদ্দ হলোÑ
নবাবকে মেরে ব্রিটিশরা এলোÑ
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে
বাংলার সমস্ত ভ‚মির মালিকানা চলে গেলো জমিদারদের হস্তে।
জমিদারদের হুকুমে,
পাইক-পেয়াদার জুলুমেÑ
চাষিরা ফসল ফলায়
তাঁতিরা কাপড় বোনে
তার সিংহভাগ চলে যায়
জমিদারদের সিংহাসনে।
জমিদার কিছু খায়,
আর ব্রিটিশদেরকে কিছু পাঠায়,
এমনি করে করে
বাংলার সম্পদের ভাÐারে লন্ডনে ওঠে গড়ে
দালান, কোঠা, কলকারখানাÑ সব,
প্রথম শিল্পবিপ্লব।
নিজ নিজ স্বার্থরক্ষার টানে
বিদ্রোহে, রণে,
বাঙালি ছোটে মজনু শাহের আহŸানে,
ভবানী পাঠকের গানে,
তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায়,
শরিয়াতুল্লাহর ফরায়েজি মহল্লায়,
সিপাহী বিদ্রোহের কলতানে,
স্বদেশি আর অসহযোগ আন্দোলনে।
ওয়েস্টফালিয়া চুক্তি আর ফরাসি বিপ্লবের পর,
ইউরোপের জনমনে আসে নতুন প্রহল,
তার আছর লাগে বাঙালিরও প্রাণে,
নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির টানে,
জাতীয়তাবাদ জন্ম নেয়
বাঙালির কবিতায়,
প্রবন্ধে, ছন্দে, ছড়ায় ও গানেÑ
বাঙালির প্রাণে।
বাঙালি না মুসলিম না আরবীয়?
বাঙালি না হিন্দু না ভারতীয়?
এইসব নিয়ে পরিচয়ের দ্ব›েদ্ব
বাঙালি স্বাচ্ছন্দে
বেছে নেয় বহু পরিচয়Ñ
এরই প্রেক্ষিতে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কয়:
“আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য
তার চেয়েও বেশি সত্য
আমরা বাঙালি।”
স¤প্রদায়ে সম্প্রদায়ে স্বতন্ত্র পরিচয়ে পাশাপাশি বেড়ে ওঠে বাঙালি:
বাঙালি মুসলমানÑ বাঙালি ও মুসলমান উভয়;
বাঙালি হিন্দুÑ বাঙালি ও হিন্দু উভয়।
ব্রিটিশের দাসত্বের আবরণে
আপন অধিকারের আহŸানে,
ধীরে ধীরে ব্রিটিশ উপনিবেশে,
বাঙালি প্রজারা নিজনিজ আদর্শে
জাগ্রত হয়,
সচেতন হয়।
ঊনিশ শত পাঁচ সালে
মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় বঙ্গভঙ্গের কালে,
হিন্দু বাঙালির বিরোধিতায়
বাঙালি মুসলমান আহত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দ্ব›েদ্বর প্রতীক হয়ে মূর্ত হয়।
বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের বিরোধিতায়,
বাঁজলো যে স্বদেশির সুর,
বাঙালি মুসলমানের স্বার্থহানি ঘটায়,
সার্বজনীন হয়ে সেই সুর হলো না মশহুর।
হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের আহŸানে:
পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মিলনের আহŸানে,
কবিগণ করলেন নিবেদন,
রবির সুরে বাঁজল ভালোবাসার কারণ:
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…”।
অগ্নিবীণায় কবি নজরুল,
ঝড়ালেন বিদ্রোহের ফুল:
“মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত,
আমি সেইদিন হবো শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না।”
ব্রিটিশ বাংলায়
দফায় দফায় বাঙালি মুসলমান পিছিয়ে যায়, সকল সুবিধায়।
ঊনিশ শত তেইশ সালে,
দেশবন্ধু-শেরেবাংলার চেষ্টার ফলে,
‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এর আওতায়,
বৈষম্য নিরসন, হালে পানি পায়।
দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর ‘বেঙ্গল প্যাক্টের’ মৃত্যু হলো,
বাঙালি মুসলমান আশা হারাল।
চাষা, মজুর, মুসলমান প্রজা,
জমিদারের জুলুম হতে চাইল ‘রোজা’।
শেরে বাংলা ছাড়লেন হুঙ্কার:
“লাঙ্গল যার, জমি তার।”
জমিদারের স্বার্থের কারণে,
হিন্দু নেতারা দিল না সাড়া শেরে বাংলার আহŸানে।
জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্তে¡ সমর্থন দিতে
বাঙালি মুসলমান বাধ্য হলো অস্তিত্বের স্বার্থে।
ঊনিশ শত চল্লিশ সনে,
লাহোরের ময়দানে,
বাংলার বাঘ ফজলুল হক কন্ঠ করলেন শক্তিশালী:
“আমি প্রথমে মুসলমান, পরে বাঙালি।”
দ্বিধার দ্বৈরথে বাঙালি মুসলমান,
একদিকে ভাষা আর সংস্কৃতির টান,
অপরদিকে উম্মাহর উখুয়াতের আজান।
দ্বিধার ত্রৈরথে বাঙালি হিন্দুর তিন দেহ:
একদিকে অখÐ বাংলা মায়ের দেহ,
অপরদিকে অখÐ বাংলায় সংখ্যালঘু হয়ে অধিকার হারাবার সন্দেহ,
অপরদিকে মহাভারতের বিশালতার প্রতি ¯েœহ!
একদল করে পেশোয়ার থেকে ডিব্রæগড় পর্যন্ত এক পতাকার আহŸান,
তাতে, অধিকার হারাবার ভয়ে মূর্চ্ছিত মুসলমানের সন্দেহ মূর্তমান।
মুসলমানের অধিকার সংরক্ষণে
মন্ত্রিমিশন প্লানে
জিন্নাহ রাজি হলেন কংগ্রেস-পতি মওলানা আজাদের আহŸানে।
নেহরু কংগ্রেসের নয়াপতি হয়ে
উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চাপ খেয়ে,
বললেন বোম্মাইয়ে:
“কংগ্রেস পূর্ণ প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে না।”
হতবিহŸল মুসলমানের আর সহ্য হচ্ছে না,
ক্রোধে, ভয়ে, বিষ্ময়ে জিন্নাহ ঘোষিলেন:
“অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন”।
ষোলই আগস্ট কলকাতায়,
ধর্মঘট করতে গিয়ে কচুকাটা হয়,
হাজারো মুসলমান,
হিন্দুরো যায় প্রাণ,
দাঙ্গায়
কলকাতায়,
নোয়াখালীতে,
বিহারে ও দিল্লিতে
কচুকাটা হয়
হাজারে হাজার হিন্দু-মুসলমান;
মানুষের যায় প্রাণ।
দাঙ্গার ভয়ে,
অধিকার হারাবার সংশয়ে,
বাঙালি মুসলমান,
দমাইয়া বাঙালিত্বের টান,
জান করে কোরবান
আনলো পূর্ব পাকিস্তান।
দাঙ্গার ভয়ে,
অধিকার হারাবার সন্দেহে,
বাঙালি হিন্দু কুড়াল মারল বঙ্গমায়ের দেহে।
শরৎ বসু-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তবঙ্গের আহŸান ছুড়ে ফেলে,
পশ্চিমবঙ্গ আশ্রয় নিল ভারতের আঁচলে।
অধিকারের খোয়াবে বাঙালি মুসলমান
ছেঁচল্লিশের নির্বাচনে
ভোট দেয় হারিকেনে
জিন্নাহকে ইজ্জত করে,
শেরে বাংলাকে ছুঁড়ে মেরে,
জান করে কোরবান, বাঙালি মুসলমান আনল পাকিস্তান।
রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি বহুধা বৃহত্তর অধিকারের স্থান।
মহান নেতা জিন্নাহ
মুখের ওপর শুনলেন, “না, না।”
পরে, ঊনিশশত বায়ান্নে,
ফেব্রæয়ারির অপরাহ্নে,
বাঙালি মুসলমান, আবার দিল জান, কারণ ছিল অধিকারের আহŸান।
রক্ত দিয়ে পাওয়া পবিত্র ভ‚মি পাকিস্তানি ইসলামী জুমহুরিয়াত
বাঙালি মুসলমানকে দিল না ইনসাফ,
আজাদীর খোয়াবের হল বরখেরাফ,
‘আমরা সবাই সমান’
ইসলামের এই সুমহান ¯েøাগান
পাকিস্তানে হলো বরবাদ, বাঙালি মুসলমান করল না বরদাশত।
পাকিস্তানে অধিকারের প্রশ্নে বাঙালি মুসলমান
পাঞ্জাবি-সিন্ধি-পশতুদের ডেকে কয়,
আমায় দাও পরিচয়;
অধিকারের দাবে ¯েøাগান দেয় তুলি
“তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি”
পাকিস্তানের এই ¯েøাগান, বাঙালি মুসলমানের না রয় প্রয়োজন, বাঙালির সাথে জুড়তে ‘মুসলমান’।
জান করে কোরবান বাঙালি মুসলমান ভাঙল পাকিস্তান।
পঁচিশে মার্চের রাতে
পাকিস্তানের সেনাদের আঘাতে
নিহত বাঙালির রক্তের ¯্রােতে
ভেসে উঠে আশ্রয় নিল ভারতে;
তারপর, অস্ত্র হাতে বাঙালি মুসলমান, জেগে উঠে টুঁটল পাকিস্তান।
বাঙালিত্ব আর মুসলমানিত্ব
কোনোটাই তো ছাড়েনি তো
বাঙালি মুসলমান,
অধিকার আর অস্তিত্ব রক্ষায়
যখন যে পরিচয় দরকার হয়,
তখন সেটাকেই সুমুখে দেয় স্থান।
স্বাধীন বাংলাদেশে
অবাঙালি বাংলাদেশিদের অধিকারের প্রশ্ন আসে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সকাসে
চাকমাদের প্রতিনিধি এসে
দাবি জানায়: আমাদের স্বতন্ত্র পরিচয় দাও,
উত্তর পায়: “তোমরাও বাঙালি হয়ে যাও।”
যুগ যুগ ধরে
বাংলায় বাস করে
নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, আর্য, আরব
মঙ্গোল, কোল, ভীল, তামিলেরা সব
এক ভাষা এক কৃষ্টিতে
মিলেমিশে রুপ নেয় বাঙালিতে।
এই বাংলায় কিছু কিছু নরগোষ্ঠী,
লালন করে কিছুটা আলাদা ভাষা-কৃষ্টি,
তারা কি হঠাৎ করে
বাঙালিতে মিশে যেতে পারে?
সকল বাংলাদেশির সার্বজনীন পরিচয়Ñ
বাঙালিত্ব নয়, মুসলমানিত্ব নয়,
যদিও উভয়
একসময় এদেশে এনেছিল নতুন সূর্যোদয়।
মেটাতে দ্বিধা-সংশয়, জিয়াউর রহমান কয়:
“বাংলাদেশি” সকলের সার্বজনীন পরিচয়;
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষ:
প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ।
এই পরিচয়ে রাজনীতি মেখে যায়,
সকল বাংলাদেশির একক ‘পরিচয়’ রাজনীতির চালে থমকে যায়!
‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মিশিয়ে,
সংবিধানের ষষ্ঠ ও নবম অনুচ্ছেদে বসিয়ে,
রসিয়ে রসিয়ে আওয়ামী লীগ ভোট চায় নৌকায়।
বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে ধানের শীষের পাশে বসায়,
সেই পরিচয়ে ভোট চায়।
পরিচয়ের প্রশ্নে, তাই বাংলাদেশের মানুষ বিভক্ত হয়ে যায়।
জাতীয় ইতিহাস, জাতীয় পরিচয়, জাতীয় ¯েøাগান
আর জাতীয় অর্জন দলের দখলে নেওয়ার আখ্যানÑ
আমাদের জাতীয় পরিচয় সংকটের মূল কারণ, যেমন;
‘দালাল’, ‘গাদ্দার’,
‘জামাত’, ‘শিবির’, ‘রাজাকার’,
ইত্যাদি অভিধা দিয়ে ট্যাগের রাজনীতি আমাদের ‘জাতীয় মুক্তি’ বেহাত হবার কারণ, তেমন।
এতো রক্ত দিয়ে কী লাভ হলো জনতার,
যদি নাইবা মেলে সার্বজনীন পরিচয়ের অধিকার?
প্রাচীন ও মধ্যযুগে ‘দাস’ ছিলাম রাজার;
ব্রিটিশ আমলে পেটাল জমিদার,
আজাদীর খোয়াবে হলাম পাকিস্তানের রাহবার,
অধিকার চেয়ে গালি খেলাম ‘গাদ্দার’,
একাত্তরে রক্ত দিলাম আবার,
তারপরে, অধিকার চেয়ে গালি খেলাম ‘রাজাকার’।
চব্বিশে আমার রক্তে লাল হলো পারাবার,
গণহত্যাকারী স্বৈরাচার পথ পেল পালাবার,
এবারো পাব না আমার সার্বজনীন পরিচয়ের অধিকার?
জাগো হে বাংলাদেশের বাঙালি-সান্তালি-চাকমা-মৈতৈ,
সার্বজনীন পরিচয়ের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হই,
জাগো হে বাংলাদেশের মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও হিন্দু,
আমরা সকলে মিলে ‘বাংলাদেশ’; যেন বৃত্তের একেক বিন্দু।
হে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান,
তোমার এক ভাই না বাঁচলে, বাঁচবে না যে অপর ভাইয়ের প্রাণ;
হে বাঙালি-সান্তালি-চাকমা-চাক-মৈতৈ-পাঙ্গন,
তোমরা প্রত্যেকে ভাই ভাই, একে অপরের অঙ্গন।
জাগো হে সকল জাতের,
সকল মতের,
সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের
বাংলাদেশি সন্তান।
সম্মিলিতভাবে জাগো গাহিয়া সকল সুরের
সকল স্বরের
সকল ভাষা-সংস্কৃতির
সকল সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির
বাংলাদেশের গান।
সাহিত্যশৈলী: কবিতাটি মুক্তক ছন্দে রচিত। কবিতাটিতে মাত্রাসাম্য ও অন্তমিল সর্বদা রক্ষিত হয়নি। পর্বগুলো অসম। একেক পর্বের গঠনশৈলী ও বর্ণনা শৈলী একেক রকম। যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা বাংলায় একেক সময় একেক শাসনে যেমন একেক রকম ছন্দ লয় তাল ছিল, এই কবিতাটির প্রতিটি পর্বে অসম কাঠামো তেমনি অসমতার মধ্যে একেক রকম অ¤øমধুর তাল-লয়-ছন্দ নিয়ে আবর্তিত।

রচনাকাল: ২২ আগস্ট, ২০২৪
author

রাজা আবুল কালাম আজাদ

Raja Abul Kalam Azad is a post-modern researcher, writer, journalist, environmental activist, and teacher. He completed his bachelor's and master's degrees in disaster management at the University of Dhaka. His various research articles have been published in reputed international journals. Currently, he is working as a teacher at a government school and serving as the coordinator of the Disaster Economics Unit of Disaster Perception, a Dhaka-based organization. He is the Secretary General of 'Muktatma Samiti' and one of the Members of the Independent Bangla Editorial Board.

এই ধরণের আরো...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial