ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচারের এক দুষ্ট হাতিয়ার এক মহাফ্যাসাদ,
জনতার অধিকার বরবাদ করবার ফাঁদ এই মতবাদ।।
জনতার হক মেরে স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগবিলাস আর ক্ষমতার তরে
স্বৈরাচার এক ফন্দি তৈরি করে যাতে জনতার দৃষ্টি সড়ে
আর সে জনতার ঘাড়ে পা রেখে করতে পারে স্বেচ্ছাচার আবাদ।।
ফ্যাসিবাদ এমন ব্যবস্থা চায়, যাতে বিশেষ গোষ্ঠী সুবিধা পায়;
তারা স্বেচ্ছায় গুÐার গান গায় আর চোট্টামির লাইসেন্স পায়,
আর এদের ওপর ভর করে জনতার হক মারে ফ্যাসিবাদ।।
ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার সরকার সাজে দেশপ্রেমের ইজারাদার,
জাতীয় ঐতিহাসিক ঘটনার করে অত্যন্ত অতিরিক্ত প্রচার,
জনতাকে ক্ষেপায়, কথায় কথায় শত্রæদেশকে দিয়ে অপবাদ।।
দেশপ্রেমের মুখোশের আড়ালে তারা উগ্রজাতীয়তাবাদ পালে,
নেতাকে নবি বানায় সেই তালে আর চুরি করে তার ডামাডোলে,
এ নিয়ে কেউ বললে, ফ্যাসিবাদ তার জীবনটাই করে বরবাদ।।
স্বার্থলোভী, গুÐা ও কবিকে নিয়ে মিথ, মতবাদ ও মিডিয়া দিয়ে,
সদা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে ছড়িয়ে আর জনতাকে বুঝিয়ে-শাসিয়ে,
সমাজ-অর্থনীতি দখলে নিয়ে ফ্যাসিবাদ করে চোরের আবাদ।।
ফ্যাসিবাদের দাবিটা চিরন্তণ: সবকিছুর চ‚ড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ,
সমাজের মাঝে দৃঢ় বিভাজন: একদলকে লালন ও তোষণ,
অন্যদলকে ‘দেশের শত্রæ’ বলে শোষণ, নিপীড়ন ও অপবাদ।।
দেশের শত্রæদের উস্কে দিয়ে আর কিছু কৃত্রিম শত্রæ বানিয়ে,
নিত্য উত্তেজনায় দেশ মাতিয়ে কিংবা দেশের কোনো গোষ্ঠীকে নিয়ে
জনগণকে তাঁতিয়ে ফ্যাসিবাদ করে যায় নিজ স্বার্থের আবাদ।।
ফ্যাসিবাদ এক ভ্রষ্ট মতবাদ, ছোট্ট একগোষ্ঠীর সুবিধাবাদ,
অধিকার হতে জনগণ বাদ, জনতার স্বপ্ন সব বরবাদ।
ভÐ-লুটেরা-খুনিরা কাল্টের টুপি পরে আবাদ করে ফ্যাসিবাদ।।
রচনাকাল: ১৬ আগস্ট ২০২৪
সাহিত্যশৈলী: প্রতিটা পঙক্তি ২৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে ছন্দে রচিত।
উৎস:
টীকা ভাষ্য
(ক) ফ্যাসিবাদ : ফ্যাসিবাদ হলো একটা রাজনৈতিক নোংরা কৌশল ও মতবাদ। একধরণের স্বৈরাচারী সরকার উগ্র ডানপন্থী (ক্ষেত্র বিশেষে বামপন্থী, জাতীয়তাবাদী, বা মধ্য পন্থী হতে পারে) কিছু জনপ্রিয় মতবাদ ধারণ করে এবং প্রচার করে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করে। স্বৈরাচারের বিভিন্ন কায়দা-কানুন ব্যবহার করে এইসব মতবাদকে সমাজে ও রাষ্ট্রে জোর করে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। ফ্যাসিবাদী সরকারের জন্য সহায়ক হয় এরকম জনপ্রিয় ইস্যু, ধর্মীয় বা জাতীয় আবেগের সাথে জড়িত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ‘সমালোচনার অযোগ্য’ করে একটা পবিত্র আবহ তৈরি করা হয়। একই সাথে রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরণের সুবিধাগোষ্ঠী তৈরি করা হয়, যারা ফ্যাসিবাদ থেকে অবৈধভাবে সুবিধা নিতে থাকবে, আর সর্বদা ফ্যাসিবাদের পক্ষে দৃঢ়ভাবে কাজ করবে। একইসাথে রাষ্ট্রের কিছু জনগোষ্ঠীকে ‘দেশের শত্রæ’ হিসেবে উপস্থাপন করে উক্ত গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ-ভাবাপন্ন গোষ্ঠীকে ফ্যাসিবাদের দলে ভেড়াবে। এই প্রক্রিয়ায় ফ্যাসিবাদের সমর্থকগোষ্ঠী উত্তোরত্তর অন্যায়ভাবে সুবিধা নিতে নিতে রাষ্ট্রের শক্তিশালী সিন্ডিকেটরূপে আবির্ভূত হয়। অপরপক্ষে, ‘দেশের শত্রæ’ চিহ্নিত গোষ্ঠীর ওপর উত্তররোত্তর জুলুম নির্যাতন বেড়েই যায়, এমনভাবে ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়, যে উক্তগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নকে ‘জায়েজ’ মনে করা হয়। ‘দেশের শত্রæ’ ট্যাগ পাওয়া এইসব ব্যক্তিরা ক্ষেত্রবিশেষে গণহত্যারও স্বীকার হয়। আবার, সাধারণ জনগণের কোনো অংশ তাদের বৈধ কোনো দাবি নিয়ে সরব হলে, যেকোনো ব্যক্তি এই ট্যাগের স্বীকার হয়ে নিপীড়িত হতে পাবে। সাধারণ জনগণের কোনো দাবি যদি ফ্যাসিবাদী সুবিধাগোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিক‚লে হয়, তাহলে ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী অনেক নৃসংশ হয়ে উঠতে পারে। যাহোক, ফ্যাসিবাদের মূল কৌশলটা হলোÑ স্বৈরাচারী রাজনৈতিক গোষ্ঠী কিছু জনপ্রিয় মতবাদ, আদর্শ, ব্যক্তি ও প্রতীক ব্যবহার করে জনগণকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে, বুঝিয়ে-শাসিয়ে দমিয়ে কিংবা মাতিয়ে রেখে শাসন ও শোষণ বজায় রাখা।
(খ) কাল্ট : এটি ফ্যাসিবাদের একটি হাতিয়ার। রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতা, আধ্যাত্মিক গুরু, দার্শনিক প্রভৃতির মধ্যে যারা ফ্যাসিবাদী শক্তির মূল ব্যক্তিত্ব, তাদেরকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যার কোনো যুক্তিসংগত সমালোচনা করারও সুযোগ রাখা হয় না। কবিতায়, “নেতাকে নবি বানায় সেই তালে আর চুরি করে তার ডামাডোলে” পঙক্তিতে ‘নবি’ শব্দটিকে কাল্টের উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আব্রাহামীয় ধর্মগুলোতে ‘নবি’ যেমন দোষমুক্ত, এবং তার সমালোচনা করা পাপ, তেমনি ফ্যাসিবাদে ‘নায়ক’ চিত্রিত ব্যক্তিগুলোকেও চিত্রিত করা হয়।
(গ) মিথ : যুগযুগ ধরে লোকমুখে প্রচলিত বিভিন্ন কাহিনী, বিশ্বাস, প্রথা ও আচারাদিকে মিথ বলে। কিছু কিছু মিথকে ধর্মের অংশ হিসেবে বিশ্বাস করা হলেও সকল মিথ ধর্মবিশ্বাসের অংশ নয়। মিথ লোকসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ।
(ঘ) মতবাদ: কোনো গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির কর্তৃক নির্দিষ্ট বিষয়ে একধরণের বিশ্বাসকে মতবাদ বলে। কোনো অধ্যয়নশাস্ত্রের নির্দিষ্ট বিষয়ে পÐিতগণের একই শ্রেণিভ‚ক্ত মতামত বা বিশ্বাসকেও ‘মতবাদ’ বলা হয়। আবার কিছু বিষয়ের ওপর কোনো ধর্ম বা উপসম্প্রদায়ের বিশ্বাসের সমষ্টিকেও মতবাদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন মতবাদে ব্যবহৃত বিশ্বাসকৃত বিষয়গুলো ‘সত্য’ বা ‘সঠিক’ বলে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হতেই হবে, এমন কোনো শর্ত নেই। একটি মতবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তি মতবাদটিকে সত্য বলে মেনে নেয়, তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে। যেমনÑ ফ্যাসিবাদ, নাজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, মার্কসবাদ, মাওবাদ, মুজিববাদ এগুলো হলো রাজনৈতিক মতবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিদের পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিসমূহকে ‘রাষ্ট্রপতির মতবাদ (চৎবংরফবহঃরধষ ফড়পঃৎরহব) বলে অভিহিত করা হয়। যেমনÑ ট্রুমান ডকট্রিন, মনরো ডকট্রিন, ওবামা ডকট্রিন ইত্যাদি। খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ, জৈনধর্মের ‘অনেককান্তবাদ’, প্রভৃতি হলো ধর্মীয় মতবাদ।
(ঙ) প্রোপাগান্ডা : কোনো দল বা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে মিথ, মতবাদ, আদর্শ এবং বিভিন্নপ্রকার সত্য, অসত্য ও অর্ধ-সত্যের মিশ্রণে দলগত প্রচারনাকে প্রোপাগাÐা বলে। প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে অনেক সময় সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে দ্রæত গুজব ছড়ানো হতে পারে। অনেক সময় যেকোনো ছোট্ট ঘটনাকে বড় করে দেখানো, বা বড় ঘটনাকে ছোট করে দেখানোর জন্য একটি ঘটনাকে নিয়ে একেক স্বার্থগোষ্ঠী স্ব-স্ব গোষ্ঠীর সপক্ষের তথ্য ও যুক্তির মাধ্যমে ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করা হয়। ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কবিতা, সংগীত থেকে শুরু করে গবেষণাপত্র পর্যন্ত ব্যবহার হতে পারে। প্রোপাগান্ডার প্রচার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে গ্রন্থ, পুস্তিকা, প্রচারপত্র, পত্রিকা, ওয়েবসাইট, বøগ, প্রভৃতি। আজকাল প্রোপাগান্ডার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।