বাস্তববাদের বাস্তবতা

স্বাধীনতা ১.০: ব্রিটিশ বিতারণ ১৯৪৭

কলকাতায় ক্লাইভের রংশালায় বাজে ঐ ‘দ্রাম দ্রাম’ ঢাকঢোল;
মুর্শিদাবাদে লুৎফুন্নেসার আলয়ে আজি ‘হুঁ হুঁ’ কান্নার রোল!
ব্রিটিশ বেনিয়া কোম্পানি নিয়ে নিল বাংলার শাসনের ভার,
শোষণে অশনে অশনি, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে এ বাংলার
এক তৃতীয়াংশ মানুষ ভাতের অভাবে করল ইন্তেকাল;
আমাদের পূর্বপুরুষ দেখল এক নিকষ নৃশংস কাল!
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সমস্ত ভ‚মির মালিকানা চলে গেলো
জমিদারদের হস্তে, যারা ব্রিটিশের ‘রাজাকার’ বনে গেলো।
ভ‚মিহারা, বাস্তুহারা, অধিকার-হারা জমিদারের প্রজারা
দাসত্বের বন্ধনে পড়ল ধরা; দুঃসহ দুঃখসাগরে সারা,
জাতির ক্রান্তির সেই কাল! ফলে, সোনার বাংলা হলো শ্মশান,
ঐ জঞ্জাল ব্রিটিশ ধানক্ষেতে নীল চষিয়ে মারল কৃষাণ;
“ব্রিটিশ তাড়াতে অস্ত্র ধরো, বাঁশের কেল্লায় প্রতিরোধ গড়ো,
তাঁবেদার জমিদারদেরকে ধরো, কৃষক-প্রজাদের মুক্ত করো”_
এই আহŸানে বাংলার বীর তিতুমির কায়েম করে রাজত্ব,
ঘোষিলেন বার্তা মুক্তির, ভেঙ্গে গোলামীর জিঞ্জির ও দাসত্ব।
এ জীবনের মায়া ত্যাগ করে অস্ত্র ধরে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে,
দ্রোহ দেখালেন শরিয়াতুল্লাহ সে অসম যুদ্ধে,
জীবন দিলেন গোলাম মাসুম, সূর্যসেন আর ক্ষুদিরাম,
কাজী নজরুল ঘোষিলেন দ্রোহসুরে আজাদীর পয়গাম:
“আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান-বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন”; ঠিক,
এই তীর ব্রিটিশরাজের অভিমুখে, বুঝেছো কি হে সৈনিক?
আঠারো শত সাতান্নে দ্রোহের আগুনে জ্বলন্ত সিপাহী সৈন্যে,
মোগল বাদশাহ ও হিন্দু রাজন্যে, ঐক্য হলো আজাদীর জন্যে;
স্বদেশি, খিলাফত, সত্যাগ্রহ আর অসহযোগ আন্দোলন
ব্রিটিশদের অন্তরে জাগালো সন্দেহ আর শঙ্কার কম্পন;
ব্রিটিশ ভারতের নিষ্পেষিত মুসলমান হলো আগুয়ান,
মুসলমান এলাকায় গড়তে পাকিস্তান করল আহŸান,
কংগ্রেস দল বলল, “মোরা অখণ্ড এক ভারত রাষ্ট্র চাই”,
শরৎ-সোরাবর্দীর দাবি ছিল: “অখণ্ড স্বাধীন বাংলা চাই।”
বাতলালো ব্রিটিশ মন্ত্রীমিশন: “মুসলমানের স্বায়ত্তশাসন
আর অধিকার হবে সংরক্ষণ, তিন স্তরে হবে ভারতশাসন”;
জিন্নাহ-গান্ধী-আজাদ এ ফর্মুলায় মানলেন মুক্তির আবাদ,
সংরক্ষণে উগ্র হিন্দুরা করলে প্রতিবাদ, শান্তি হলো বরবাদ;
এ আঞ্জাম হেরফেরে ইঙ্গিত দিল কংগ্রেসের নয়াপতি নেহরু,
ক্ষোভে-ভয়ে-সংশয়ে মূর্ছিল মুসলমান, জিন্নাহ হলেন না ভিরু,
তিনি ঘোষিলেন, “অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন,
লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, পাকিস্তানকে লেঙ্গে অ্যাকশন জোর অ্যাকশন”।
কলকাতায় কচুকাটা হলো হিন্দু-মুসলমান, জোরবার সে দাঙ্গা
জান দিয়ে মুসলামান চাইল পাকিস্তান, জমিন হলো রাঙ্গা,
প্রাণের খুনে জোরবার হলো_  স্লোগান-আহ্বান: “অ্যাকশন, অ্যাকশন
লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, পাকিস্তানকে লেঙ্গে অ্যাকশন জোর অ্যাকশন,
লড়কে লেঙ্গে আজাদী, আজাদী কি লেঙ্গে, অ্যাকশন আওর অ্যাকশন”।
এইভাবে ‘পাকিস্তান’ হয়ে গেলো মুসলমানের মুক্তি-সমান।
ব্রিটিশ শাসন আর নয়_ বলল হিন্দু-মুসলমানের শক্তি,
আটচল্লিশে নয়, সাতচল্লিশের চৌদ্দ আগস্ট এলো মুক্তি।
এলো নতুন ভোর, নতুন আশা, নতুন পতাকা ও মানচিত্র;
এলো নতুন স্বপ্ন, নতুন ভরসা, আর নতুন শত্রু-মিত্র;
বিদায় নিল জমিদার, আমরা পেলাম ভূমির অধিকার,
‘দাস’ হতে নাগরিক হবার সুযোগ পেলাম প্রথম বার;
ঊনিশ শত সাতচল্লিশে প্রথম মুক্তির স্বাদ পেল জনতা,
এই কারণে সাতচল্লিশই আমাদের প্রথম স্বাধীনতা।
রক্তাক্ত দেশভাগ ও ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র টুটিল বঙ্গের অঙ্গ,
বাংলার শতকরা নব্বই ভাগ শিল্পযন্ত্র পেল পশ্চিমবঙ্গ।
র‌্যাডক্লিফ কমিশনের বিভাজনের সুবাদে পেল ইন্ডিয়া,
মুসলিম-প্রধান মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, পুর্ণিয়া…।
পেলাম পোকায় খাওয়া পাকিস্তান, তার যে সমস্যা নানান।
দুই পাখার অসম অবস্থান, মোদের দিল সীমিত ত্রাণ-

                                                                   পাকিস্তান।

সাহিত্য বিশ্লেষণ:
কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। কবিতার প্রতিটি পূর্ণপঙক্তি ২২ মাত্রার। একটিমাত্র অপূর্ণ পঙক্তি ৪ মাত্রার, যা কবিতাটির শেষে রয়েছে। কবিতাটিতে দ্বৈত অন্তমিলের পাশাপাশি প্রতিটি দ্বৈত পঙক্তির ভেতরে নানামাত্রিক অনুপ্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে, যা কবিতাটিকে ইতিহাসের মত চলমান ও বেগবান করে তোলে। কবিতাটিতে রয়েছে ৮টি স্তবক। এর মধ্যে প্রথম ৬টি স্তবকে ৮টি করে পূর্ণ পঙক্তি রয়েছে। ৭ম এবং ৮ম স্তবকে পূর্ণ পঙক্তির রয়েছে ৬টি করে, ৮ম স্তবকে অতিরিক্ত ৪ মাত্রার একটি অপূর্ণ পঙক্তি রয়েছে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের হিসেবে, ৬৩ পঙক্তির এই কবিতাটিতে রয়েছে মোট ১৩৬৬টি মাত্রা, যা হিজরি ১৩৬৬ (১৯৪৭ খ্রি. ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ) সালকে নির্দেশ করে। কবিতাটির শেষ পর্ব দু’টির অপূর্ণতা, পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোতে আমাদের আজাদীর অপূর্ণতাকেও ইঙ্গিত করে।
author

রাজা আবুল কালাম আজাদ

Raja Abul Kalam Azad is a post-modern researcher, writer, journalist, environmental activist, and teacher. He completed his bachelor's and master's degrees in disaster management at the University of Dhaka. His various research articles have been published in reputed international journals. Currently, he is working as a teacher at a government school and serving as the coordinator of the Disaster Economics Unit of Disaster Perception, a Dhaka-based organization. He is the Secretary General of 'Muktatma Samiti' and one of the Members of the Independent Bangla Editorial Board.

এই ধরণের আরো...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial