“পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়দ-ই-আজম জিন্দাবাদ”_
স্লোগানে স্লোগানে বাংলার জমিনে শুরু হলো আবাদ:
ইসলামের জাগরণ, জমিদারি উচ্ছেদের আয়োজন,
গরিবী টুটানোর মহারণ, ও জনগণের উন্নয়ন।
চাঁদতারার নয়ানিশানে, জেলে-মাঝি-মজদুর-কিষাণে,
যে খোয়াব দেখলো পাকিস্তানে ঈমানে, আজাদীর শানে,
বড় পরিমাণে বরবাদ হলো সেই স্বপ্নের স্বাদ,
স্বার্থের দ্ব›েদ্ব বেড়ে গেলো মন্দের আবাদ।
পাকিস্তানের ছাপ্পান্ন ভাগই বাংলার সন্তান,
বাকিরা পাঞ্জাবি, সিন্ধি, আফগান, হিন্দি-মোহাজেরান।
সমগ্র দেশে শতকরা জনা ছয়, উর্দুতে কথা কয়;
দেশের উভয় পাখায় যোগাযোগের অছিলায় বলা হয়:
“উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।”
কী সর্বনাশা! ফুঁসলো বাঙালি চষতে মুক্তির আশা!
“এটা মানলে এক্সাম হলে সুযোগের অসমতার ফলে,
বাঙালি যাবে বিফলে, বাঙালির ভাষা ও পরিচয় যাবে অতলে!”
“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”_ বাঙালিরা চাইল অধিকার,
শাসকেরা বাঙালিকে দিল ধিক্কার, ‘গাদ্দার, গাদ্দার’,
‘ভারতের দালাল’, ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’, নানা গালাগাল;
মউতকে ইস্তেকবাল! সালাম-রফিক খুনে হলো লাল!
ভাষার প্রতিবাদে জন্ম নিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ,
বাঙালির অস্তিত্বেও তাগিদে বরবাদ হলো পাক-উখুয়াত,
চুয়ান্নর নির্বাচনে বাঙালির ভোট-জোয়ারের টানে,
আজাদীর ইমাম দল মুসলিম লীগ যেতে নয় আসনে।
যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলে, ষড়যন্ত্রের ক‚টচালে
ছাপ্পান্ন দিনের মাথায় তাদের ক্ষমতা চলে যায়!
অপরাজনীতির বেড়াজালে মাসে মাসে সরকার বদলে,
ফাকতালে, আইয়ুব খান ক্ষমতা নেন চিকন কৌশলে।
সামরিক আইনের মার: খতম হলো আজাদী জনতার,
গণতন্ত্রের বদলে এবার ‘চাটুকারী ভোটাধিকার’;
জনতাকে জাহেল করতে শিক্ষাকে পণ্য করে গড়তে,
ষড়যন্ত্রটা রুখতে, আন্দোলন হলো বাষট্টিতে।
আমার পূর্ব বাংলায় কারখানার অপ্রতুলতায়,
সস্তা কাঁচামাল বস্তায় বস্তায় করাচিতে যায়!
করাচির শিল্পপণ্য বাংলায় ফেরে সমুদ্রঘুরে,
ঢাকা-করাচির বাজারে তাই বেচাকেনা হয় পৃথক দরে।
পাটের দাম পূর্ব বাংলায় কম, চটের দাম যে বেশি!
পশ্চিমের উপনিবেশি বণিকেরা পেল শোষণের রশি!
আইয়ুব-গোষ্ঠীর প্রতিপত্তি-উন্নতি-দুর্নীতি,
গড়ল বাংলার দুর্গতি: এক দেশ দুই অর্থনীতি।
পয়ষট্টির যুদ্ধে লাহোরে-কাশ্মীরে বাঙালিরা লড়ে,
বাংলার সুরক্ষার তরে পাকিস্তানের সেনারা কী করে?
বাংলার কোটায় বিহারী-পাঞ্জাবি-সিন্ধি চাকরি পায়,
বাংলার মন্ত্রীরা ওঠে-বসে-খায় করাচির ভাষায়!
Ñএসব বৈষম্যের করতে রফা, মুজিব দিল ছয় দফা।
এতে ঐ কোর্ফা-উপনিবেশি শোষকদের পথ হলো মাপা!
অধিকার চেয়ে ‘গাদ্দার’ গালি খেলো বাংলার সন্তান,
জান ও মাল কোরবান করে যারা এনেছিল পাকিস্তান।
অধিকার চাওয়ার অপরাধে বাঙালি কাঁদে, পদে-পদে,
মিছে অপবাদে, হামলা-মামলায় আহতের আর্তনাদে,
বাংলার আকাশে-বাতাসে দ্রোহ ভাসে করুণ নিশ্বাসে;
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার রেশে বাঙালি ফোঁসে উচ্ছ¡াসে!
ঊনসত্তরে উঠল গড়ে এগারো দফার আন্দোলন,
সহিংসতার কবি ভাসানীর ভাষণ, জাগল জনগণ:
“রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন ঝন রণরণ ঝন ঝনঝন”:
আইয়ুব করে পলায়ন, আসে ইয়াহিয়া খাঁর শাসন।
সত্তরে নির্বাচন: জনগণ করে পথনির্ধারণ,
একপক্ষে দেশপ্রেমের মেকি বুনন ও ধর্মরণ,
অপরপক্ষে ইশতেহার: জনগণের কিছু অধিকার:
জিতে গেলো এবার যারা ছিল গণঅধিকারের দাবিদার।
এলো জনতার রায়, সংবিধান হতে হবে ছয় দফায়,
ফেডারেল কাঠামোয় স্বায়ত্তশাসন হবে বাংলায়,
গণতন্ত্রের নিয়মে সরকার গড়বে শেখ মুজিব।
জাগে বাঙালির আশার প্রদীপ, হাসে বাংলা ব-দ্বীপ।
“এধার হাম, ওধার তুম”_ ভুট্টো ভাগ চায় ক্ষমতার,
লোভ জাগে ইয়াহিয়া খাঁর, প্রেসিডেন্ট থেকে যাবার।
আলোচনার নামে চলে টালবাহানা, সামরিক আনাগোনা;
ভাসানীর নির্দেশনা: “মুজিব, ওরা ক্ষমতা দেবে না,
তুমি দিয়ে দাও স্বাধীনতার ঘোষণা, আর দেরি কোরো না।”
ছাত্রজনতার পারাবার অপেক্ষা আর করল না:
স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো,
মুক্তিকামী জনতা সংগঠিত হলো, _ স্লোগান তুলল:
“বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।”
ছাত্রজনতা জাগলো আরো, মুক্তির মিছিল হলো বড়।
পাকিস্তানে বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনতা চায় ‘সাম্য’,
পশ্চিম তা দেবে না, তাই ফের আজাদীই এবার কাম্য।
বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অবিচার
রুখতে চাই: ‘মানবিক মর্যাদা’, ‘সামাজিক সুবিচার’;
ফের নয়া-আজাদীর আঞ্জাম: লাল-সবুজের পরচাম,
সাত মার্চের পয়গাম: এবার মুক্তির সংগ্রাম।
জাগে যে জনগণ, সুমুখে মহারণ, মুক্তির আহŸান:
জান দিয়ে পাকিস্তান এনেছিল যে বাঙালি মুসলমান,
তারা বারবার অধিকার চেয়ে আর গালি খেয়ে ‘গাদ্দার’,
গালি বা অবমাননার পরোয়া করল না আর, এইবার।
স্পষ্টকণ্ঠে বাঁজে ডঙ্কা: “ পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা।”
কাঁপে সমগ্র বঙ্গ এলাকা: আর যে ঘরে যায় না থাকা!
ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে, বাঙালিরা রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে,
ঊনিশে মার্চ গাজীপুরে বাঙালিসেনা প্রতিরোধ গড়ে।
জনতার ওপরে পাকিস্তান গুলি করে,
স্বাধীন বাংলাদেশ ভেসে ওঠে রক্তসাগরে!
ঐতিহাসিক পটবিশ্লেষণ:
সাহিত্য বিশ্লেষণ:
কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। কবিতার শেষ স্তবক ব্যতীত প্রতিটি স্তবকের প্রতিটি পূর্ণপঙক্তি ২২ মাত্রার। শেষ স্তবকে দুইটি অসম মাত্রার পয়ারে যথাক্রমে ১৬টি এবং ১৯ মাত্রার। সবমিলে কবিতাটি ১৯৭১টি মাত্রা নিয়ে গঠিত, যা ১৯৭১ সালকে নির্দেশ করে।