বাস্তববাদের বাস্তবতা

আমার ঐ পথ চাওয়াতেই আনন্দ

আমি ইনতেজার আখন্দ। ঢাকায় আমার জন্ম, ঢাকায়ই বেড়ে ওঠা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্যই স্নাতকোত্তর শেষ করলাম। সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেই নাই; বিদেশে পড়তে যাব বলে আই.ই.এল.টি.এস ও জি.আর.ই-এর প্রাথমিক প্রস্তুতিটা নিয়ে ফেলেছি। এরই মধ্যে কোভিড-১৯ এসে গেল। সমগ্র বিশ্বের সীমানাগুলো বন্ধ হতে লাগল। অ্যারোপ্লেনেও আর যুক্তরাষ্ট্র যাওয়া যাচ্ছে না। এক ধরনের হতাশার আবহ তৈরি হলো আমার বন্ধুমহলে, যারা মিলে যুক্তরাষ্ট্র যাবার প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম। সবকিছু স্থবির হওয়ায় আমারও হতাশার বাতাস লাগার কথা, কিন্তু কেন যেন তা লাগছে না। কেবলি মনে হচ্ছে__ যায় দিন এমনি যদি যায় যাক না।

চাকরি আমার ভালো লাগে না। পড়তে ভালো লাগে। চিন্তা করতে ভালো লাগে। নিত্য নতুন তত্ত্ব-কথা ভাবতে ভালো লাগে আর লিখতে ভালো লাগে। লেখালেখি ভাল লাগে বলে সাংবাদিকতা ও বই লেখার প্রতিষ্ঠানেই চাকরি নিয়েছিলাম আমি। কিন্তু ঐ যে, চাকরির ধরাবাঁধা নিয়ম! প্রতিদিন রুটিন করে অফিসে যাওয়া! এসব তো আমার একদমই ভালো লাগেনি। তাই, দুটো চাকরিই আমি ছেড়ে দিয়ে এসেছি।

পাঠকবৃন্দ এতোক্ষণে আমার মননের একটি আইডিয়া হয়তো পেয়ে গেছেন। কিন্তু ছেলেটি কে? দেখতে কেমন__ এমন প্রশ্ন কি মাথায় এসেছে? আসতে পারে__ আচ্ছা, আমি আমার পরিচয়টা আরো একটু খোলাসা করছি।

আমি বাঙালি মুসলমান পরিবারের সন্তান। আমাদের বংশীয় গোত্র সাথে ফারসি নামের বলে অনুমান করতে পারি, আমাদের কোনো পূর্ব পুরুষের সাথে পাঠান-ইরানিদের সম্পর্ক থাকতে পারে। আবার, আমাদের চেহারাতেও পশতু-রোহিল্লা পাঠানদের মিল আছে। আমার চেহারার বর্ণনা দেই, বাকিটা আপনাদের বিবেচনা।

আমি লম্বায় গড় বাঙালি পুরুষদের চেয়ে খানিকটা বেশি লম্বা। নাকটা উঁচু। মুখের গড়ন কিছুটা লম্বাটে, অর্থাৎ গোলও নয়, আবার অধিক লম্বাটেও নয়। গাত্রবর্ণে আমি ধবধবে ফরসাও নই, কালোও নই।

আমার দৈহিক গড়নের ব্যাপারে আরো একটু বলি। নিয়মিত ব্যায়াম করি, নিয়ম করে খাই-দাই, ঘুমাই। তাই, আমার স্বাস্থের অবস্থা ভালো। বেশি মোটাও নই, বেশি চিকনও নই, আবার জিমন্যাস্টদের মতো অতোটা সুঠামও নয় আমার দৈহিক গড়ন। পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়ে চোস্ত উর্দুতে কথা বললে আমাকে পাকিস্তানি মনে হবে, পশতুতে কথা বললে পাঠান মনে হবে, খারিবোলি-হিন্দুস্তানিতে কথা বললে রোহিল্লা মুসলমান মনে হবে আর বাংলায় কথা বললে খাঁটি বাঙালিই মনে হবে। অর্থাৎ, আমি এমন চেহারার মানুষ, যাকে কাবুল হতে শিলচর পর্যন্ত_ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্রই পাওয়া যাবে।

কোভিড-১৯ এর লকডাউন চলে। বাসায় কিছুটা গৃহবন্দীর মতোই কাটাই। পড়াশুনার বাইরে ফেসবুকে জনসচেতনতার জ্ঞান দিয়ে বেড়ানোই আমার নিত্যদিনের কর্ম। এরই মধ্যে বাসায় একটি মেয়ে এলো, আমাদের দুসম্পর্কের আত্মীয়া। নাম নবনী, পড়ে নবম শ্রেণিতে। ছিপছিপে গড়ন। গায়ের রং বাঙালি মানদণ্ডে কালো। চোখ দুটো দোয়েল পাখির মতো__ সাদা-কালোর মিশেলে অপূর্ব সুন্দর। ঠোঁটের গড়নে চিত্রনায়িতা সুচিত্রা সেনের ছাপ আছে, মায়াবি অথচ সাধারণ। লম্বা চুল। উচ্চতা বাঙালি নারীর গড় উচ্চতার চেয়ে কিছুটা বেশি। নাকটা অনেকখানি আমারই মতোন। হয়তো আত্মীয়তার সূত্রে এই মিল!

আরো মিল আছে মেয়েটার সাথে আমার। সেও আমার মতো পড়তে ভালোবাসে; ভাবতে ভালোবাসে। আর, সুযোগ পেলে সে আমারই মতন করে দুয়েকটা করে কবিতাও লেখে। তার মনের সৌন্দর্য চেহারার সৌন্দর্যের চেয়েও উজ্জ্বল প্রতিভাত হতে লাগলো।

শুরুতে সে বাসায় আসায় আমি কিছুটা বিরক্ত হলেও, ওর সাথে দুয়েকটা কথাবার্তা বলতে বলতে বিরক্তিটা কেটে গেল। উঠন্তি বয়সের তরুণির বাড়ন্ত-উড়ন্ত মন তার আচরণে ফুটে ওঠে। কথা বলে মৃদু হেসে। অভিমান করে কুমড়ো ফুলের বেশে! আর  তার রাগের গন্ধ রজনীগন্ধার মতো মধুর হয়ে নাকে আসে। বেলি ফুলের শুভ্রতার মতো তার স্নিগ্ধতা কে না ভালোবাসে?

তার চিন্তা ও আচরণের মধ্যে আমারই প্রতিফলণ দিনদিন আমায় মুগ্ধ করে। ধীরে ধীরে সে আমার শিষ্য হয়ে গেল। তাকে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান আর ইংরেজিতে পাঠদান করতে লাগলাম, তবে আলোচনার ফোকাসটা দিনদিন বিজ্ঞান থেকে সড়ে এসে সাহিত্য, প্রেম, দর্শনে চলে আসতে লাগল।

তার প্রকৃতি ও আচরণ যেমন আমার কৌতুহলী মনে কৌতুহলে উদ্দীপনা জাগাতে লাগল, আমায় নিয়ে তার মনের কৌতুহলও আমার নজরে আসল। আমার ব্যক্তিগত বিষয়াদি জানার ব্যাপারে তার আগ্রহ প্রচুর। পড়ানোর ফাকে ফাকে সুযোগ পেলেই ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করে। আরো প্রশ্ন করে জীবন ও জগতের নানান দার্শনিক ব্যাপার-স্যাপারে।

জীবন ও জগৎকে একটু ভিন্ন করে বুঝে দেখার ক্ষেত্রেও আমার মতোই আগ্রহ তার। তাই, সম্ভবত দুজন ভিন্ন বয়সের মানুষের মাঝে বন্ধুত্বের মতন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল।

এতে করে মুশকিল হচ্ছিল পড়ানোতে। পদার্থবিজ্ঞানের বর্ণালী পড়ানোর ফাঁকে কেউ যদি আপনাকে প্রশ্ন করে, “নীল রং কেন আপনার প্রিয় হলো, লালও তো হতে পারতো?”_ তাইলে কি আপনার মনোযোগ পদার্থবিজ্ঞানে থাকে?

এর থেকে বাঁচার জন্য একটা ফন্দি আঁটলাম। বিজ্ঞান পড়ার সময় শুধুই বিজ্ঞান নিয়েই আলোচনা। অন্য টপিকে প্রশ্ন আসলে, সেটার বিহিত হবে আলাদা সময়ে। পড়াশুনার বাইরের বিষয়াদিতে প্রশ্ন আসলে সেটা সে লিখে দেবে। আমি লিখে উত্তর দেব লিখে। আমার কোনো প্রশ্ন থাকলেও তার বিহিত হবে একইভাবে। আমার ধারণা হলো, এতে পড়ানো ও খুচরা আলাপের সময় আলাদা হবে। পড়াশুনার সময় পড়াশুনা এবং আলাপের সময় আলাপ।

এতে এক অদ্ভূত ঘটনা ঘটে গেল। তার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমিও কিছু প্রশ্ন করলাম। আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সেও পাল্টা আরো কিছু প্রশ্ন করল। এইভাবে একের পর এক প্রশ্ন আর উত্তরের ধারা অনন্তধারায় রূপ নিল। এতে করে নিজের জীবনের কত অদ্ভূত ব্যাপার যে বেড়িয়ে আসল, সেটা সেই সুযোগ তৈরি না হলে জানাই হতো না। সেই সময়টা ছিল নিজেকে চেনার সময়, মানুষ চেনার সময়, পৃথিবী চেনা সময়, জগৎ ও তার নিয়ম চেনার সময়। কেন আমি এমন, কেন অমন হলাম না, সে কেন অমন, সে কেন অমন হলো না, আমি অমুক পথে লাভ রেখেও কেন আমি তমুক পথে স্বল্প লাভের জন্য ছুটে চলেছি? সুখটা আসলে কী? শান্তি কী? মজা কী? ভালো লাগা কী? মন্দ লাগা কী? বিষন্নতা কী? হতাশা কী? আমার কীসে ভালো লাগে? কেন ভালো লাগে? কীসে মন্দ লাগে? কেন মন্দ লাগে? এই ঘটনায় তখন কেঁদেছিলাম কেন? এখন হলে কান্না আসবে না কেন? এই ঘটনাটা অমুকভাবেই কেন ভেবেছি, তমুকভাবেও তো ভাবতে পারতাম, কিন্তু ভাবলাম না কেন?

এইসব হাজারো প্রশ্ন আর সেসবের ভিন্নভিন্ন আঙ্গিকের উত্তর।

প্রথমে খোলা পৃষ্ঠায় লিখছিলাম। এর পর খাতা। একটার পর আরেকটা খাতা। এমন করে ৭টি খাতা শেষ হয়ে গেল।

লকডাউন তখন কিছুটা শিথিল হয়ে এসেছে। দম বন্ধ করা বন্দিত্ব আর ভালো লাগে না। একদিন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, হাটতে বেড়ুবো। হাটতে হাটতে ঢাকার বাইরে চলে যাব। একেবারে পল্লির লোকালয়ে।

হাটতে হাটতে আমরা ধানক্ষেতের শিশির ভেজা পথ পেয়ে গেলাম। নদী পেরুলাম নৌকা করে। আবার ধানক্ষেত। এরই মধ্যে একটা ছোট্ট খালের মতো ড্রেন। আমি লাফ দিয়েই পাড় হতে পারবো। তার জন্য সেটা কঠিন। আমি পাড় হয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। সে লাফ দিয়ে আমার বুকে চলে এলো। বিদ্যুৎ চমকের মতো কী যেন আমার সমস্ত শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল।

আমরা আবার হাটতে শুরু করলাম। এর মধ্যে কিছুটা উচুঁ বিরানভূমি পাওয়া গেল। কিছু বড় বড় গাছ, বাঁশ আর ঝোঁপ। আশপাশে কোনো মানুষ দেখা যায় না। কী মনে করে হঠাৎ আমি তার হাতটা আমার হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিলাম। হঠাৎ করে কেন যে এমন করলাম! আমার কোনোই পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। একেবারেই অকস্মাৎ!

কিছুটা সম্বিত ফিরতেই আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি! হাতটা ছেড়ে দিয়ে ‘স্যরি’ বলবো বলে ভাবছি, তখন লক্ষ করলাম সেও আমার হাতটা চেপেই ধরল! ভয় কিছুটা কমল, কিন্তু লজ্জা আর কাটে না। তবু হাত ধরাধরি করেই আমরা হেটে চললাম অনেকক্ষণ।

এরই মধ্যে সে কী যেন একটা জন্তু দেখতে পেল! কুকুরের মতো দেখতে কিন্তু কুকুর নয়! শিয়াল হবে হয়তো। দেখে সে ভয়ে কুঁকড়ে গেলো। আমাকে জড়িয়ে ধরল।

দূর থেকে দুটো লোক দেখতে পাওয়ায় ছাড়িয়ে নিলাম। কোন পথে যাবো, কোন দিকে গেলে সুপথ পাবো, সেই জ্ঞান আমাদের নাই। পথ না চেনা দুরন্ত অভিযাত্রিক আমরা। কিছুটা এগিয়ে এসে একটা বালককে পেলাম। কীভাবে লোকালয়ে পৌঁছুব, তার দিকনির্দেশনা নিতে লাগলাম। ছেলেটির নির্দেশিত পথে ও এগিয়ে গেল। ছেলেটি আমাকে আরো কিছু প্রশ্ন করছিল। ওর উত্তর দিতে আমি আরেকটু দাঁড়ালাম। উত্তর শেষ করে, ও যেপথে চলে গেছে, সেই পথেই এগুলাম। অনেক দূর চলে আসলাম, ও নেই! পেছনে না সামনে যাব ভেবে পাচ্ছি না। কাউকে জিগ্যেস করেও খুঁজে পাচ্ছি না। তার কাছে কোনো ফোনও নেই, যে কল করবো। অনেক খুঁজলাম। অনেক ডাকলাম। নবনী, অবনি, তরণি, ধরণি__ ওর সবগুলো নাম ধরে। খুঁজে পেলাম না।

কোথায় গেল? সে কোথায় গেল__ আমি খুঁজে পেলাম না।

তার চলে যাওয়ার পথেই বসে আছি। তার স্মৃতিগুলো যখন খুব করে মনে পড়ে, আমি তার লেখাগুলো পড়ি। প্রশ্নোত্তরের পর্বে আমাদের যে খাতাগুলো লেখা হয়েছিল, সেই খাতাগুলো খুলে তার লেখাগুলো ছুঁয়ে দেখি। আর যখন আমার মন একেবারেই ব্যাকুল হয়ে পড়ে তখন শহর ছেড়ে এই মেঠোপল্লির উপকন্ঠে চলে আসি। তার হারিয়ে যাবার পথের পানে চেয়ে থাকি।

এই পথে হাটতে হাটতে একটি ইউক্যালিপটাস গাছের কাণ্ডগাত্র আমার চোখ আটকালো। চেয়ে দেখি, লেখা রয়েছে:

সেদিনের ওই অস্পষ্ট সন্ধ্যার মতো ছবি হয়ে রবো।

কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে আমার কণ্ঠস্বর

তবু কথা কবো

কানে কানে গানে গানে

নীরবতার কলতানে;

যতটুকু স্মৃতি দিয়ে গেলাম তোমাদের মনে

আমি হয়তো ততটুকুই;

যতটুকু ছবি এঁকে গেলাম তোমাদের হৃদয়ের চিত্রপটে

আমি হয়তো ততটুকুই;

হয়তো আমি কেবলি ছবি,

তোমার অন্তরে জেগে ওঠা কবি,

হয়তো আমি এতোটুকুই।

author

রাজা আবুল কালাম আজাদ

Raja Abul Kalam Azad is a post-modern researcher, writer, journalist, environmental activist, and teacher. He completed his bachelor's and master's degrees in disaster management at the University of Dhaka. His various research articles have been published in reputed international journals. Currently, he is working as a teacher at a government school and serving as the coordinator of the Disaster Economics Unit of Disaster Perception, a Dhaka-based organization. He is the Secretary General of 'Muktatma Samiti' and one of the Members of the Independent Bangla Editorial Board.

এই ধরণের আরো...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial