বাংলাদেশে সাম্প্রতিক তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণ ও প্রতিকার

কয়েকদিন হলো রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়া সত্ত্বেও লোডশেডিং অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এই নিয়ে অনেকে অনেক অভিযোগ দিচ্ছেন, অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড নিয়েই প্রশ্ম তুলছেন।
আমি নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে এই অবস্থার কিছু কারণ এবং এ অবস্থা উত্তরণের জন্য কী করা যায়, সেই উপায় নিয়ে কিছু কথা বলব।

সাম্প্রতিক তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণ:

১. অত্যধিক তাপমাত্রা এবং সিস্টেম লস: তীব্র গরমে বিদ্যুৎ পরিবাহী তারগুলোর রোধ বেড়ে যায়। ফলে, সিস্টেম লস বেড়ে যায়। এই জন্য, এই তীব্র দাবদাহের কালে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও সেই হারে বেশি বিদ্যুৎ বাসাবাড়ি পর্যন্ত পৌছানো যাচ্ছে না।
২. বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি: এই তীব্র দাবদাহে বিদ্যুৎ পাওয়ামাত্র সবাই একযোগে ফ্যান, লাইট ইত্যাদি চালু করে দেয়। রেফ্রিজারেটর (ফ্রিজ), এসি, এগুলোও চালু হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। অনেকে আবার বিদ্যুৎ আসামাত্র বিনোদনের নানান উপকরণ যেমন_ টেলিভিশন, সাউন্ডবক্স, ইত্যাদি চালু করে দেয়।
কিন্তু, এতো চাহিদা একসাথে পুরণ করা সম্ভব নয়। কারণ, একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করা যায় না। এটা করতে গেলে সিস্টেমই কলাপ্স করবে।
৩. বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট ও উচ্চমূল্য:
করোনা পরবর্তী চাহিদার উল্ল্মফন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপীই জ্বালানির মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। বিশ্ববাসী যে কতোটা চাপে আছে এই জন্য, এটা পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, এসব দেশ ভালো করে বুঝছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তেল/গ্যাস/ কয়লা ইত্যাদি জ্বালানি দিয়েই। জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দেশকেও তাই হিমশিম খেতে হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে। কারণ, আমরা জ্বালানি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পুর্ণ নই।
উচ্চমূল্য দিয়ে বিভিন্ন রাঘব বোয়ালকে ম্যানেজ করে আমাদেরকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ আমদানি করতে হয়। সেই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ দিয়ে দেশের সব কল-কারখানা চলে। সেই কল-কারখানার পণ্য রপ্তানি করে আমরা খাদ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদি আমদানি করি। এইভাবে আমাদের অর্থনীতির চাকা ঘোরে। এই চাকা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের বেচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।
বিশ্ব-রাজনীতির এই প্রতিকূল পরিবেশেও আমাদের অর্থনীতির চাকা যে এখনো ঘুরছে, এই জন্য আমাদের ১০ বার আলহামদুলিল্লাহ পড়া উচিৎ ।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া-ইউরোপ এদের শত্রুতার খেলায় সব পক্ষের সাথে সম্পর্ক ঠিক রেখে বাংলাদেশের মতো একটা ক্ষুদ্র রাষ্ট্র টিকে আছে, এইটা চাট্টিখানি কথা নয়।
৪.রমজান মাস ও ঈদ উপলক্ষ্যে বিশেষ চাহিদা:
(ক) পবিত্র রমজান মাসে ইতিকাফ ও তারাবির জন্য মসজিদ্গুলোতে ফ্যান ও এসির ব্যবহার বাড়ে।
(খ) রমজান ও ঈদ উপলক্ষ্যে বিশেষ কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এইসব পণ্য উৎপাদন করতে জ্বালানি ও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়।
(গ) ঈদযাত্রায় এদেশের একটা বড় অংশ দেশের বাড়িতে যায়। অন্যান্য যাতায়াতও বাড়ে। ফলে, পরিবহন খাতে জ্বালানি চাহিদা বেড়ে যায়।
৫. সেচ মৌসুমের বিশেষ বিদ্যুৎ চাহিদা:
বর্তমানে দেশের একটা বড় অংশে বোড়ো সিজনের ধান চাষ চলছে। এই ধানে সেচের কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহার বেশি হচ্ছে ।
উপরিউক্ত কারণগুলোর জন্য বর্তমানে বাসাবাড়িতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকার ইচ্ছে করে আপনাদের কষ্ট দিচ্ছে না।

এই সংকট মোকাবেলায় করণীয়:

আমরা ক্ষুদ্র পরিসরে নিম্নলিখিত কাজগুলোর মাধ্যমে একটু একটু করে যদি বিদ্যুৎ ব্যবহার কমাতে পারি, তাহলে লোডশেডিংয়ের প্রকোপ একটু হলেও কমানো সম্ভব:
১.বিনোদনযন্ত্রগুলো এই কয়েকদিন পারতপক্ষে পরিহার করা/ কম ব্যবহার করা। সাউন্ডবক্সের ব্যবহার বন্ধ করা।
২. ফ্যান/এসি ব্যবহারে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়া ।
৩. প্রয়োজন ছাড়া ভ্রমণ পরিহার করা/ ভ্রমণপথ সংক্ষিপ্ত করা।
৪. সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো। যাদের বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ আছে, তাদের বাড়িতে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে সার্বক্ষণিক সৌরবিদ্যুৎ চালু রাখা।
৫. ব্যাটারি চালিত রিকশা/ অটো ভ্যান নিয়ন্ত্রণ। অন্ততপক্ষে, তীব্র সংকটের এই একটা মাসের জন্য নিয়ন্ত্রণ জোড়দার করা।
এছাড়া, আরো ভালো ভালো উপায় চিন্তাভাবনা করে আপনারা বের করতে পারেন; এবং সেই চিন্তাগুলো জনতার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারেন।

author

রাজা আবুল কালাম আজাদ

Raja Abul Kalam Azad is a post-modern researcher, writer, journalist, environmental activist, and teacher. He completed his bachelor's and master's degrees in disaster management at the University of Dhaka. His various research articles have been published in reputed international journals. Currently, he is working as a teacher at a government school and serving as the coordinator of the Disaster Economics Unit of Disaster Perception, a Dhaka-based organization. He is the Secretary General of 'Muktatma Samiti' and one of the Members of the Independent Bangla Editorial Board.

এই ধরণের আরো...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial