বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এবং বাংলাদেশের ভেতরের দিকে, যদি রাজনীতি, ভূ-রাজনীতি ও অর্থনীতির দিকে যদি একটু চোখ-কানা খোলা রেখে নজর রাখেন, তাহলে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নাই। একটু খবরের কাগজ পড়ে দেখুন, কিছুটা আঁচ করতে পারবেন। তবে, ভালোভাবে বোঝার জন্য কিছু বিশেষজ্ঞের আর্টিকেল পড়ুন। ইউটিউবে সস্তা ভিডিও লেকচার না শুনে, জ্ঞানবান বিশেষজ্ঞদের লেখাগুলো পড়ুন, বক্তব্যগুলো শুনুন। তারপর, বুঝতে পারবেন।
আমি ছোট মানুষ। পত্রিকার সংবাদ পড়ে, ঝুলিতে থাকা কিছু রাজনীতি-অর্থনীতির তত্ত্বীয় জ্ঞান ব্যবহার করে আপনাদের সামনে কিছু কথা নিয়ে হাজির হয়েছে। আশা করি, এই কথাগুলো আপনাদেরকে সতর্ক ও সচেতন হতে সহায়তা করবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় ঐক্য গঠনের জন্য ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করেছে। সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক কাঠামোগত সংস্কারের জন্য এই কমিশন। এই কারণে, অনেকে সরকারের এই কাজটাকে শুধুই একটা ‘পলিটিক্যাল কাজ’ বা ‘সরকারি কাজ’ হিসেবে দেখছেন।
আমি মনে করি, এই কাজটা পলিটিক্যাল কাজের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এই কাজটাকে রাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা না করে জাতীয় দিক থেকে বিবেচনা করলে, বুঝতে পারবেন, এই কাজটা ড. ইউনুস নিজের জন্য করছেন না, বরং দেশের কল্যাণেই এই কাজটার দরকার আছে।
তবে, আমি মনে করি: শুধু সংস্কারের জন্যই নয়, আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনসমূহের এবং বিভিন্ন জাতি-ধর্মের মানুষের মধ্যে সত্যিকারের মনখোলা ভাবের আদান-প্রদানের কাজটা বেশি জরুরি। সত্যিকার অর্থেই আমাদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া, সহমর্মিতা ও একতা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। সংস্কারের চাইতেও এইটা বেশি জরুরি।
কেন, জরুরি, সেইটা আপনারাই বুঝতে পারবেন; আমি শুধু কয়েকটা তথ্য তুলে ধরছি।
ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা
বাংলাদেশ একটি কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে, যা বৈশ্বিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা, মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
বিশ্বশক্তিগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের মধ্যে বাংলাদেশ যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা রাজনৈতিক বিভক্তি ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে নিজেদের দুর্বল করে তুলি, তাহলে বহির্বিশ্বের শক্তিগুলো আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারে।
বিশেষ করে, মিয়ানমারে যেসব ঘটনা ঘটছে, সেভেন সিস্টারে, মিজোরামে, চিন স্টেটে, আরাকানে কী কী ঘটছে একটু খোঁজ খবর রাখুন। অন্তত আলতাফ পারভেজ ভাইয়ের লেখাগুলো এক দফা পড়ে নিন, ভালো করে। আইডিয়া পাবেন।
রোহিঙ্গা নিয়ে রিসেন্ট যা যা হচ্ছে, চোখ রাখুন।
অর্থনৈতিক সংকট ও জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে, রপ্তানি খাতে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে, এবং মুদ্রাস্ফীতি জনজীবনকে কঠিন করে তুলছে। ২০২৬ সালে যখন বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (LDC) তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। এই পরিস্থিতিতে যদি সব দল ও সব মতের মানুষ পারস্পরিক শত্রুতা ভুলে দেশের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ না করে, তবে সরকারের পক্ষে এই ঢেউ সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে। দেশ একেবারে ফতুর হয়ে যেতে পারে।
ভেতরের বিভাজন: আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ, ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অবিশ্বাস এবং জাতিগত বিভক্তি আমাদের ঐক্যকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
ইতিহাস সাক্ষী যে, কোনো জাতি যদি অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত থাকে, তাহলে তারা সহজেই বাইরের শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এবং ইউরোপের কিছু দেশের ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি, বিভাজনের ফলে কীভাবে জাতিগুলো নিজেদের স্বাধীনতা ও স্থিতিশীলতা হারিয়েছে। বাংলাদেশ যেন সেই একই পথে না হাঁটে, সে জন্য আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে।
জাতীয় ঐক্যের জন্য আমাদের করণীয়
১. রাজনৈতিক বিভাজন দূর করা: সরকার ও বিরোধী দলকে পারস্পরিক শত্রুতার পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে। একপক্ষ অপর পক্ষকে ধ্বংস করার নীতি গ্রহণ করলে তাতে দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
-
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা: মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান—সব ধর্মের মানুষকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে জাতির ঐক্য নষ্ট হবে।
-
জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া: ব্যক্তি বা দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
-
সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দায়িত্বশীল ব্যবহার: অপপ্রচার, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, যাতে কোনো গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দল সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারে।
ঐক্য অথবা মৃত্যু : একতা না থাকলে পরিণতি ভয়াবহ
বাংলাদেশ এখন এমন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা— ঐক্য অথবা মৃত্যু । যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা শুধু অর্থনৈতিক সংকট নয়, বরং বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, নিরাপত্তা হুমকি, এমনকি স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারি।
তাই জাতীয় ঐক্যের জন্য আমাদের শুধু বক্তৃতা নয়, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সব রাজনৈতিক দল, সব ধর্ম, এবং সব জনগোষ্ঠীর মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও স্বনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।