আমাদের আধুনিক গণতন্ত্রের প্রবক্তারা বলছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি জিনিসটা “গণতান্ত্রিক রাজনীতি” ও “ধর্ম” উভয়ের জন্যই খারাপ। ধর্মকে অপরাজনীতির হাত থেকে বাঁচাতে ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরী করতে “ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, ধর্মের নামে রাজনীতি” এসবই নিষিদ্ধ করতে হবে।
তারা বলছেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশে জন্য ধর্মীয় রাজনীতি একটি বিষ ফোঁড়া। কারণ, গণতন্ত্রের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ (ভ্যালু) যুক্ত করা হলে বা ধর্মীয় ফ্লেভার যুক্ত করা হলে, ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রার্থক্য তৈরী হয়। একই যোগ্যতা সম্পন্ন দুই ধর্মের প্রার্থীকে ভোট দেওযার সময়, ধর্ম একটা নতুন মাত্রা যোগ করে। ধর্মীয় ফ্লেভারের কারনে কম যোগ্য ব্যক্তিরও নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা তৈরী হয়।
আবার, গণতন্ত্রে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি গৃহিত হলে, সংখ্যালঘুদের জন্য সমঅধিকার সৃষ্টিতে আরো নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয়। সংখ্যালঘু মত দুর্বলতর হতে থাকে। এর ফলে, গণতন্ত্রের যে মুল কথা: সকলের সমান অধিকার, সেটাই বাঁধাপ্রাপ্ত হয়।
বিষয়টি আরো পরিস্কার করছি। আধুনিক গণতন্ত্রের মুল স্তম্ভ “এক ব্যাক্তি এক ভোট নীতি”। এই নীতির মূল কথা হলো, “সকলের ভোটের সমান মুল্যায়ন।” এই নীতিটি তৈরী হযেছে এ্ই ধারনা থেকে: “গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক সম্পূর্ণরুপে জনগণ। দেশের প্রতিটি অংশের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে সকলের অধিকার সমান (বাংলাদেশ সংবিধানেও একথা লেখা আছে। ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই এই মূলনীতি ব্যবহৃত হয়)। সুতরাং, সকল নাগরিকের সমাধিকার নিশ্চিত করতে হলে, সকলের ভোটের মূল্যও সমান করতে হবে। কিন্তু, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা হলে, বা ভোটদানের ক্ষেত্রে ধর্মকে বিবেচনার মধ্যে আনা হলে, সকলের ভোটের সমমূল্যায়ন হয় না। বিভিন্ন গবেষকগণ দেখিয়েছেন, ধর্মীয় বিবেচনায় ভোটের তারতম্য হয়।
অতএব, আধুনিক গণতন্ত্র যে মূলনীতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে (সকলের সমঅধিকার), তা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে “ধর্মীয় রাজনীতি” নিষিদ্ধের বিকল্প নাই।
অপর পক্ষে, ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্ম তিনটির রাজনীতি যে সকল মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা স্পষ্টত, আধুনিক গণতন্ত্রের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক।
আধুনিক গণতন্ত্রের মূল কথা: সকল নাগরিকের সমান অধিকার। সকলের জন্য সমান আইন।
আমার জানামতে, উপরিউক্ত তিনটি ইব্রাহিমীয় ধর্মের মূল কথা: মহাবিশ্বের সবকিছুর অধিকর্তা একমাত্র আল্লাহ। অতএব, (আধুনিক গণতন্ত্রের আইনের পরিবর্তে) সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আইনই প্রাধান্য পাবে। আমার জানামতে তিনটি ধর্মতেই স্বধর্মীয় ও পরধর্মীয়দের বিচারের জন্য আলাদা আইন রয়েছে।
গণতন্ত্রের মূল দাবি, “জনগণ ক্ষমতার উৎস।” উপরের তিনটি ধর্মের দাবি, “আল্লাহই ক্ষমতার উৎস।”
ফলে, ধর্মীয় রাজনীতির মূল্যবোধে বিশ্বাসী ব্যাক্তি, গণতন্ত্রের মূল দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ নন।
এসব কারণে, “গণতান্ত্রিক রাজনীতি”র সাথে “ধর্মীয় রাজনীতির” একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা বিদ্যমান। একের প্রতিষ্ঠা অপরের জন্য হুমকি স্বরুপ।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশের মানুষের সামনে তিনটি পথ খোলা:
(১) ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করে, গণতন্ত্রের পথের অন্যান্য কাঁটাগুলো দূর করে “প্রকৃত” অর্থে আধুনিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আমার মতে, এই পথই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ জনগণকে দিতে পারে।
(২) গণতন্ত্রকে বিদায় দিয়ে সম্পূর্ণরুপে ধর্মীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে বিজয়ী ধর্মের ধর্মীয় আদর্শ সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পেলে (যে কোন ধর্ম হোক) বেশ কিছু প্রকারের দূর্নীতি ও অনাচার থেকে জনগণ রক্ষা পাবে। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধুলিস্মাৎ হবে। ব্যাক্তিস্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা ও আধুনিক মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যাবে। বিজয়ী ধর্মীয় জনগোষ্ঠী ব্যতীত অপরাপর জনগোষ্ঠীর ধর্মী স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হতে পারে।
(৩) ধর্ম ও গণতন্ত্রের মূল্যবোধের সংমিশ্রণে নতুন এক মূল্যবোধ তৈরী করা। এই মূল্যবোধ গণতন্ত্র ও ধর্ম কোনোটার মূল্যবোধকেই সম্পূর্ণ গ্রহণ করবে না- আবার পরস্পরের বিরোধের স্থানগুলোতে একটা নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি করবে। উভয় মূল্যবোধের অংশগুলো এমনভাবে নিতে হবে, যেন মানুষ ও সমাজের সর্বাধিক উপকার করা যায়। এজন্য নতুন তত্ব ও নতুন যুক্তি তৈরী করতে হবে। পাকিস্তানের কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিকেরা এমন কিছু চেষ্টা করে যাচ্ছে। বেনজির ভুট্টো একটা বই লিখেছে এই নিয়ে। ইসলাম, ডেমোক্রেসি রিকনসিলিয়েশন। আমার অনুমান, এ্ই পথটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। গণতন্ত্রের এই পাকিস্তানী স্টাইল খুব বেশী স্থায়ী হবে বলেও মনে হয় না।ভাগ্য, পাকিস্তানের মতই খালে পড়তে পাড়ে।
তাই, যাই করুন, ভেবে চিন্তেই করতে হবে।
ও হ্যাঁ। বর্তমানের “ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম” আমার নিকট যুতসই মনে হচ্ছে না। বিশ্ব এগুচ্ছে; দেশ এগুচ্ছে; বিশ্বের ও দেশের মানুষের মগজ এগুচ্ছে। তাই, অগ্রসরমান মগজগুলোর চিন্তার খোড়াক হিসেবে এইটুকু লিখলাম।