একটা বন্যায় কী ক্ষতি হয়? ক্ষেতের ফসল, ঘরের আসবাব, উঠোনের লাউগাছ, বাগানের ফুল__ শুধু এগুলোর ক্ষতিই কী একটা দুর্যোগের চূড়ান্ত অর্থনৈতিক ক্ষতি?
একটা পরিসংখ্যান দেই। ২০১৭ সালের বন্যায় সিরাজগঞ্জ জেলার কচিয়ার বিল অঞ্চলে বন্যার ফলে সম্পদ নষ্ট হওয়া বাবদ (যেমন, যেসব ক্ষেতের ফসল, ঘরের আসবাব, উঠোনের লাউগাছ, বাগানের ফুল ইত্যাদি ডিরেক্ট ড্যামাজ) যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো, তা ঐ এলাকার জনগণের বার্ষিক আয়ের মাত্র ২.৪৪%। অথচ, ঐবছর, উক্ত এলাকার মানুষের আয় কমে গিয়েছিলো আগের বছরের আয়ের ২১.৪৯%।
কী কারণে এমনটা হলো? মাত্র ২.৪৪% ড্যামেজ কী করে ২১.৪৯% আয় কমিয়ে দিলো? ড্যামেজের বাইরে এই বাড়তি আয় ঘাটতি (২১.৪৯%-২.৪৪%=১৯.০৫%), এটা কেন ঘটলো?
একটা বন্যা কীভাবে ঐ এলাকার মানুষের আয়ে এতো বড় প্রভাব ফেলতে পারলো? এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে কত রাত যে পার হলো নির্ঘুম! কত চিন্তা, কত বিতর্ক আর কত মানুষের সাথে কত কথা। অবশেষে পেলাম উত্তর।
২০১৭ সালের বন্যাটি ছিলো কিছুটা দীর্ঘমেয়াদি। বন্যায় দফায় দফায় পানি ওঠানামার কারণে বহু চাষী রোপা আমন ধান রোপনই করতে পারেন নাই। অল্পকজন সাহস করে লাগিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। স্বাভাবিক সময় যেসব জমিতে সড়িষা চাষ করা যায়, সেসব জমির অনেকগুলোতে সড়িষাও চাষ করা যায় নি। বন্যার পানি বিল থেকে চলে যেতে দেড়ি হওয়ায় জমিগুলোতে সড়িষা চাষের জো আসতে দেড়ি হয়েছে। ফলে, নাবি মৌসুম করে সড়িষা বোপন করেছিলেন অনেকে। নাবিতে ফলন কম। জানা কথা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল শৈত্যপ্রবাহ। ফলে, সড়িষা আবাদের খরচ তুলতেই হিমশিম খেতে হয়েছে অনেক চাষীকে।
পাঠক, লক্ষ্য করুন। বন্যা চলে যাবার অনেক পরেও চাষীদেরকে মাশুল দিতে হচ্ছে বন্যার। আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ‘ক্ষতি হিসাব ফর্ম’ দেখেছি। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রণীত ‘দুর্যোগের ক্ষতি হিসাব’ ফর্ম দেখেছি। সব ফর্মেই প্রায় একই ফর্মূলা_ কয়টা ঘর ডুবেছে. কয় বিঘা ফসলি জমি ডুবেছে, কয়টা গরু মরেছে, ছাগল মরেছে, এইসব। এইসবের কোনো ফর্ম দিয়েই যে কচিয়ার বিল এলাকার চাষীদের বন্যায় সৃষ্ট ক্ষতি হিসাব করা যাবে না, সে আমি অন্তর দিয়েই অনুভব করেছিলাম। এ নিয়ে আমার শিক্ষক মো. জুয়েল মিয়া স্যার (লেকচারার, আইডিএমভিএস, ঢাবি), ড. এ কে এম নজরুল ইসলাম স্যার (অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস, ঢাবি), শাহ কামাল স্যার (সিনিয়র সচিব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও অ্যাডজাঙ্ক ফাকাল্টি, আইডিএমভিএস, ঢাবি) প্রমুখের সাথে কত কথা বলেছি, কত প্রশ্ন করেছি সহসাই মেলে নি উত্তর। দুর্যোগকে বোঝার চেষ্টা করেছি অর্থনীতির ভাষায়। মাস্টার্সে থিসিস করেছি, যে টপিকটি নিয়ে, তাও এই প্রশ্নটিকে ঘিরেই। এ উপলক্ষেও ক-ডজন অর্থনীতির বই, আর্টিকেল, জার্নাল।
এরমধ্যে, হঠাতই আমায় পেয়ে বসল নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমত্য সেনের লেখা ‘পোভার্টি এন্ড ফ্যামিন’ বইটি। লক্ষ্য করলাম, জনাব সেন ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের (৪৩’র মন্বন্তর) অর্থনৈতিক বিশ্লেষণী করতেও আমার জিগ্যাসিত প্রশ্নগুলো নিয়ে এসেছেন।
১৯৪৩ এর ফ্যামিনের আগে মাঝারি আকারের একটা খরা হয়েছিল। এ ক্ষরায় কৃষকের ফসলহানি হয়েছিল, বটে। কিন্তু দুর্যোগের ডিরেক্ট ড্যামেজ বলতে যা বোঝায় তার প্রায় কিছুই হয় নাই। তবু, বাংলার অর্থনীতিতে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো যে এদেশের প্রায় ৩৩% লোককে না খেয়ে মরতে হলো।
এটা হলো কেন? এর ব্যাখ্যায় তিনি ফুড এন্টাইটেলমেন্ট থিউরি বের করলেন। তিনি বললেন, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো জিনিসের এন্টাইটেলমেন্ট থাকা মানে ঐ জিনিসটার উপর ঐ ব্যক্তির দুই ধরণের প্রবেশ্যতা (access) থাকতে হয়ঃ বস্তুগত প্রবেশ্যতা (Physical access) ও অর্থনৈতিক/আইনি প্রবেশ্যতা (Legal/ Economic access)। কোনো বস্তু/ সম্পদের উপর আপনার বস্তুগত প্রবেশ্যতা থাকা মানে, বস্তুটি অ্যাভেইলেবল থাকা, এবং সেটা আপনি ব্যবহার করতে গেলে কোনো বস্তুগত (Physical) বাঁধা না থাকা।
আর কোনো বস্তুর উপর আপনার আইনি/অর্থনৈতিক প্রবেশ্যতা থাকার মানে হলো, আইনীভাবে উক্ত বস্তুর উপর আপনার মালিকানা থাকা।
১৯৪৩ সালের ক্ষরায় বাংলার কিছু কিছু এলাকায় (বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ, মালদা, রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, বীরভূম, নদীয়া, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, চব্বিশ পরগণা প্রভৃতি জেলায়) ফসলহানি হয়েছিল। কিন্তু, সামগ্রিকভাবে সমগ্র বাংলার লোকেদের খাবার মতো চাল বাংলায় তখন ছিলোই। কারণ, সিলেট-ময়মনসিংহ-কুমিল্লা অঞ্চলে ক্ষরা ততোটা প্রকট ছিলো না। কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যাতে বাংলা আক্রমণ করতে না পারে, এই জন্য পূর্ব বাংলার অধিকাংশ নৌকা ধ্বংস করে দেওয়া হয়। আবার, এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ধান/ চাল পরিবহনেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি, তৎকালীন সময় ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, ২৪ পরগণা, যশোর, নদীয়া প্রভৃতি জেলার কৃষকরা সিলেট-ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চলে ধান কাটতে যেতো। ধান কেটে পারিশ্রমিক হিসেবে ধানই তারা নিয়ে আসতো নৌকায় করে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ২০১২)। মন্বন্তরের সময়, সেই ধানও আনতে বাঁধা দেওয়া হয়।
জনাব সেন (১৯৮১) ব্যাখ্যা করেছেন, ১৯৪৩’র দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ “আইনি/অর্থনৈতিক প্রবেশতার অভাব”। কারণ, দুর্ভিক্ষ কবলিত এলাকাতেও অনেক চাল মজুদ করাই ছিলো যা দরিদ্র মানুষেরা কিনতে পারে নাই। কারণ, দ্রবমূল্য। অর্থাৎ, যেসব বাজারে চালের মজুদ ও বস্তুগত প্রবেশ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক মানুষ না খেয়ে মরেছে, শুধুমাত্র “অর্থনৈতিক প্রবেশ্যতার অভাবে”।
যাহোক, জনাব সেনের দেওয়া এই প্রবেশ্যতা তত্ত্বের ধারণাটি আমাকে ২০১৭ সালের বন্যার অর্থনৈতিক প্রভাব বুঝতে অনেক সহায়তা করেছে।
আমি আমার গবেষণা এলাকায় দেখলাম, বন্যার কারণে কৃষিজমিগুলো কয়েকমাস ধরে অব্যবহৃত থাকে। ২০১৭ সালের বন্যায় এগুলো অব্যবহৃত ছিলো অনেক বেশি সময়। এর ফলে, অনেক তিন ফসলা জমি, এক ফসলা বা দো-ফসলা জমিতে পরিণত হয়েছিলো। প্রায় সবগুলো দো-ফসলা জমিতে ঐ বছর শুধুমাত্র একবারই ফসল ফলেছিলো। লক্ষ্য করলাম, বন্যাকালীন সময় জমিগুলোর মালিকানা কৃষকদের হাতেই ছিলো, কিন্তু জমিগুলো তাঁরা ব্যবহার করতে পারে নাই। অর্থাৎ, অমর্ত্য সেনের ভাষায় এই ক্ষেত্রে, বন্যার সময় কৃষকদের নিকট তাদের জমিতে ”আইনি-অর্থনৈতি প্রবেশ্যত “ থাকলেও (যেহেতু, তখনও তাঁরা ঐসময় জমিগুলোর আইনি মালিক, বর্গাদার, ইজারাদার, বন্ধকদার ছিলো, কাজেই উক্ত জমিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে তাদের আইনি প্রতিবন্ধকতা ছিলো না), তাদের নিজ জমিতেই তাদের “বস্তুগত প্রবেশ্যতা” (Physical access) ছিলো না।
এমতাবস্থায়, বিভিন্ন ধরণের ভূমিতে আমরাও অমর্ত্য সেনের তত্ত্ব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এক সেট অনুকল্প বের করেছি। অনুকল্পের ভেরিয়েবলগুলো যাচাই করেছি উক্ত এলাকার ১৮১টি পরিবারের ওপর পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত ভূমি ব্যবহারগত, কৃষি বিষয়ক ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আর্থ-সামাজিক তথ্যের মাধ্যমে।
আমরা খুঁজে পেয়েছি, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে কচিয়ার বিল এলাকার মানুষের আয় ২১.৪৯% কমে গেলো, তাঁর প্রধান কারণ, ২০১৭ সালের বন্যায় সৃষ্ট “ভূমিতে অপ্রবেশ্যতা”।
সুতরাং, আমরা অনুধাবন করতেই পারছি, বন্যার অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি কমানোর একটাই উপায়: যেসব কারণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, সেইসব কারণের গতিপথ বদলে দেওয়া? কীভাবে সেটি সম্ভব? ভূমি ব্যবহারের ধরণ বদলে ফেললেই বন্যার সময় সৃষ্ট ‘ভূমিতে অপ্রবেশ্যতা’ দূর করা যায়। সেইসাথে, বাস্তুতন্ত্রের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ, শ্রমিকদের কার্যাবলি বিশ্লেষণ ও অর্থায়নের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে ভূমি, শ্রম ও মূলধনের ব্যবহারের কাঠামো বদলে ফেললে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি যেমন কমানো সম্ভব, তেমনি বন্যাকালীন পানিসম্পদ ও ভূমির সমন্বিত ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ সম্ভব, এই দেশে।
দুর্যোগ অর্থনীতির এই সূত্রটি কেবল বন্যার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়, বরং নদীভাঙন, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, প্রভৃতি নানা দুর্যোগে নানামাত্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দুর্যোগকে সম্পদে রূপান্তর সম্ভব।
এজন্য প্রতিটি এলাকায় দুর্যোগের ধরণ ও কৃষি-বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে একটি সমন্বিত “ভূমি ব্যবহার ও দুর্যোগ রূপান্তর পরিকল্পপনা” তৈরি করা প্রয়োজন। এই পরিকল্পনা কেমন হবে, তার তাত্ত্বিক কাঠামোটি আমরা প্রস্তুত করেছি, আমাদের গবেষণাকালে।
এই কাঠামোটিসহ আমাদের গবেষণায় প্রাপ্ত মৌলিক তথ্যাবলি বিশদ প্রকাশিত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত International Journal of Disaster Response and Emergency Management (IJDEM) এ। গবেষণাপ্রবন্ধটি পড়তে নিম্নে প্রদত্ত DOI নম্বরটি ব্যবহার করুন:
এছাড়া, এই একই তত্ত্ব ব্যবহার করে কীভাবে করোনাসৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা করা যায়, সে নিয়েও কাজ করে যাচ্ছি, আমরা।
তথ্যসূত্র: