বাংলাদেশ, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের তীব্র অগ্নিকুণ্ডে জন্ম নেওয়া একটি জাতি, দুটি পরস্পরবিরোধী জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের সন্ধিক্ষেত্রে অবস্থান করছে : বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এই মতাদর্শগুলি বাংলাদেশে বাঙালি ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাধারণ ইতিহাসে শিকড়বদ্ধ ,তবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং দেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর উপর প্রভাবের দিক থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রচারিত এবং বামপন্থী ও ভারত-সমর্থিত শক্তি দ্বারা গঠিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতিগত-ভাষাগত ঐক্যের উপর জোর দেয়। এটি ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) থেকে উদ্ভূত হয়ে স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, স্বাধীনতার পর এর বাঙালী জাতিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অ-বাঙালি জনগোষ্ঠী, যেমন চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে যা সামগ্রিক সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচিত হয়। আওয়ামী লীগ ও ভারত-সমর্থিত কমিউনিস্ট-বামপন্থী দলগুলি এই মতাদর্শকে জনগণের মাঝে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, এমনকি এর অনুসারীদের “সাংস্কৃতিক অভিজাত” হিসেবে উত্থাপন করেছে, যদিও এটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনগণের কাছে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। পক্ষান্তরে, জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ১৯৭০-এর দশকের শেষে প্রবর্তন করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ যা একটি বিস্তৃত, ভূখণ্ডকেন্দ্রিক পরিচয়ের সন্ধান করে এবং ধর্মীয় অনুভূতি ও জাতিগত সীমানার বাইরে সকল নাগরিকের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ঐক্যের প্রস্তাব দেয়। ১৯৭৫ সালে ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের নিধনের পর সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই মতবাদের মাধ্যমে দেশের স্বাধীন সার্বভৌম অবস্থানকে শক্তিশালী করতে এবং ভারতীয় বলয় থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। তবে, বিএনপি এই জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠা করলেও, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তা পুরোপুরি প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ:
জাতিগত ও ভাষাগত জাগরণের ফলে উদ্ভুত বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে একটি শক্তিশালী জাতিকেন্দ্রিক জাগরণ হিসেবে আবির্ভূত হয়, যা পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক মেরুকরণের প্রতিক্রিয়া। মূলত এর উৎপত্তি ১৯৪৮ সাল থেকেই, যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু-কেন্দ্রিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। এই আন্দোলন কেবল ভাষাগত দাবি ছিল না, বরং বাঙালি পরিচয়ের একটি বিস্তৃত প্রকাশে রূপান্তরিত হয়—যা ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক উত্তর নব্য নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সাধারণ ইতিহাসে হিসেবে পরগণিত। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এই চেতনাকে কাজে লাগায়, যার পরিণতি ১৯৬৬ এর ছয় দফা ,১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান হয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
১৯৭২ সালের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, , যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে একটি সমজাতীয় বাঙালি পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে। কিন্তু এই জাতীয়তাবাদ স্বভাবতই বাঙালী জাতিকেন্দ্রিক ছিল, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য অঞ্চল এর অবাঙালি নৃগোষ্ঠীদেরকে উপেক্ষা করে। ভাষাগত ঐক্যের উপর এর মনোযোগ একটি সাংস্কৃতিক বর্ণনা গড়ে তুলেছিল, যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, এবং একটি স্বাধীন বাংলাদেশী প্রেক্ষাপটে এর সার্বজনীনতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে।
ঐতিহাসিক শিকড় ও বিবর্তন
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক শিকড় ও বিবর্তন জটিল ও বহুমাত্রিক , যা ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। এর উৎস ও বিকাশ এর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্বে বিস্তৃত। বাঙালি জাতীয়তাবাদের শিকড় প্রাথমিকভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী পুনর্জাগরণের সময়ে খুঁজে পাওয়া যায়, যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে বাঙালী সমাজে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তোলেন। এই সময়ে বাঙালি পরিচয় মূলত ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ছিল, যা হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণভাবে বিদ্যমান ছিল। তবে, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এই পরিচয়ে প্রথম রাজনৈতিক মাত্রা যোগ করে। ব্রিটিশদের ধর্মভিত্তিক বিভাজন নীতির ফলে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালী মুসলমান আলাদাভাবে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত হতে থাকে।পশ্চিমবঙ্গে কলকাতাকেন্দ্রিক জমিদার ও বুর্জোয়া হিন্দুদের একচেটিয়া সাংস্কৃতিক আধিপত্য পূর্ববঙ্গে ঢাকার সাধারণ জনতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ব্যাপক প্রভাবিত করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে ঢাকাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান ঘটতে থাকে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। এই সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তীব্র রাজনৈতিক রূপ নেয়, কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী ও সিন্ধী শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। যার সূত্রপাত ঘটে ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব দেওয়ার ফলে। যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত। এই আন্দোলন শুধু ভাষার অধিকারের জন্য ছিল না, বরং বাঙালি পরিচয় ও স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতীক হয়ে ওঠে।
বিবর্তন
১৯৫০-১৯৬০ এর দশকে ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধীরে ধীরে একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালিরা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরে। যা ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা প্রস্তাব এ অন্তর্নিহিত ছিল। আওয়ামী লীগ আন্দোলনকে আরও জোরদার করে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে। এই সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতিগত ও ভাষাগত ঐক্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, যেখানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৭১ সালে, যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে মূলত বাঙালিরা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এই যুদ্ধে ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতিগত পরিচয় একত্রিত হয়ে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র, বাংলাদেশ, প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের দুরভিসন্ধিমূলক সমর্থন এই জাতীয়তাবাদকে আরও শক্তিশালী করে। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতির মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে, এই জাতীয়তাবাদের জাতিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যার সৃষ্টি করে। চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ অ-বাঙালি জনগোষ্ঠী নিজেদের এই পরিচয়ের সঙ্গে একাত্ম করতে অস্বীকার করে, যা পরবর্তীতে ব্যাপক সংঘাতের জন্ম দেয়।
১৯৭৫-এর বিপ্লব
স্বাধীনতার পরে ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবের হত্যার পর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রভাব কমতে শুরু করে। জিয়া “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” বাস্তবায়ন করেন, যার প্রবর্তক ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। এটি জাতিগত পরিচয়ের পরিবর্তে ভূখণ্ডভিত্তিক ঐক্যের উপর জোর দেয়। এর ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য কিছুটা হ্রাস পায়, যদিও আওয়ামী লীগ পরবর্তীতে এটিকে পুনরুজ্জীবিত করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তি ছিল এর ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐক্য, যা বাঙালিদের একটি জাতিগত পরিচয় দিয়েছে। তবে, এর সীমাবদ্ধতা ছিল এর একচেটিয়া জাতিগত দৃষ্টিভঙ্গি, যা বহুসংস্কৃতির বাংলাদেশে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়। এটি মুক্তিযুদ্ধে সফল হলেও, স্বাধীনতার পর একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় পরিচয় গড়ে তুলতে অক্ষম হয়। ফলে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উত্থান এর প্রাসঙ্গিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সংক্ষেপে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি ঐতিহাসিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের জন্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, এর বিবর্তন দেশের জটিল সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সবসময় সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ১৯৭০-এর দশকের শেষদিকে জিয়াউর রহমান বাস্তবায়িত একটি বিপ্লবী ধারা হিসেবে আবির্ভূত হয়, যা মূলত প্রবর্তন করেন মাওলানা ভাসানী। ১৯৭৫ সালে ফ্যাসিস্ট মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতা গ্রহণ করেন জিয়াউর রহমান। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথিত সীমাবদ্ধতা,অবাঙালিদের বাদ দেওয়া এবং ভারতনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশীদের জাতীয় পরিচয়কে পুনঃসংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রবর্তিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ভূখণ্ডভিত্তিক ঐক্য, সার্বভৌমত্ব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সমন্বয়ের উপর জোর দেয়। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করেন, ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে “সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি নাগরিক জাতীয়তাবাদ প্রচার করেন, যা বাঙালি ও অবাঙালি সকল নাগরিককে বাংলাদেশী পরিচয়ের অধীনে একত্রিত করতে চেয়েছিল। এই পরিবর্তন কৌশলগত ছিল, ভারতের বলয় থেকে বাংলাদেশকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদের আকর্ষণ করা। এছাড়াও এটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ধর্মীয় পরিচয়কে ভাষাগত এককতার উপরে প্রাধান্য দেওয়া ব্যক্তিদের অনুভূত বিচ্ছিন্নতা দূর করার লক্ষ্য রাখে।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা এবং জিয়াউর রহমানের উত্থানের পর, বাংলাদেশ একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রোথিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে রূপান্তর একটি নতুন যুগের সূচনা করে। এই পরিবর্তন থেকেই ১৯৭৯ সালে সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে “বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম” যোগ করা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে “সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পরম বিশ্বাস ও আস্থা” প্রতিস্থাপন অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনী। এই মতাদর্শিক পরিবর্তন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় পরিচয় তৈরি করার লক্ষ্য রাখে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীসহ সকল নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করে এবং বৃহত্তর মুসলিম জাতীয়তাবাদী পররাষ্ট্রনীতির সাথে কৌশলগতভাবে সংযুক্ত ছিল।
পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন
১৯৭৮ সালের পর, জিয়াউর রহমানের অধীনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মুজিব যুগের ভারতপন্থী অবস্থান থেকে সরে এসে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির ভারসাম্য আনয়ন করে। ১৯৭১ ভুলে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা এবং চীন ও সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয়, যারা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি । মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা দ্বারা চালিত হয়, বিশেষ করে ১৯৭৩ সালে তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর উপসাগরীয় দেশসমূহে শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ এটির সুযোগ নিয়ে সৌদি আরব,কাতার,কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোতে শ্রমিক পাঠায়, যার ফলে উল্লেখযোগ্য রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। তথ্য অনুসারে, রেমিট্যান্স ১৯৭৬ সালে ১৮.৭৬ মিলিয়ন ডলার থেকে ১৯৮০-৮১ সালে ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি হয়ে যায়, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উত্থান হয়ে ওঠে। এই কূটনৈতিক কৌশল বৃহত্তর মুসলিম জাতীয়তাবাদ পরিচয়ের উপর জোর দিয়ে সমর্থিত।এছাড়া ১৯৭৪ থেকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সদস্য হয়ে ওঠে। ওআইসি এর সাথে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ১৯৭০-এর দশকের শেষ এবং ১৯৮০-এর দশকে শ্রমিক অভিবাসনের সুযোগ কাজে লাগায়, যেখানে রেমিট্যান্স অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিদেশী নিয়োগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এটিকে সহজ করে, এবং ১৯৮০-এর দশকে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন অভিবাসী শ্রমিকদের চাহিদা আরও বাড়িয়ে দেয় ফলে বাংলাদেশে এটি শুধুমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহই করেনি বরং মুদ্রাস্ফীতি এড়াতে সাহায্য করেছে, জিডিপি বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। এই সম্পর্কগুলোর কৌশলগত ও কূটনৈতিক গুরুত্ব সরকারের বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় স্পষ্ট ছিল, যা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত করে এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের সময়ে সাহায্য ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করে।
বৃহত্তর মুসলিম ঐক্যের উপর জোর শুধুমাত্র একটি কূটনৈতিক হাতিয়ার ছিল না, এটির অভ্যন্তরীণ প্রভাবও ছিল। ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সংযুক্ত হয়ে ও জাতীয় সংহতি বাড়িয়ে জিয়াউর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যার সাথে একটি আন্তর্জাতিকভাবে সাধারণ বন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিলেন , এটি ওআইসি সদস্যদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করে অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমর্থন সহজ করেছিল, যা ভারত-আমেরিকা সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়তে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে ভারত এবং মিয়ানমারের নৈকট্যের কারণে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যু
অভ্যন্তরীণভাবে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রতিরোধ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো অঞ্চলে, যেখানে চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরার মতো আদিবাসী উপজাতি গোষ্ঠী বাস করে, যাদের অনেকেই বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান । এই জাতীয়তাবাদ ভাষাগত ঐক্যের বাইরে উপজাতি এবং ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়ার লক্ষ্য রাখে, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা ছিল। এটি বিচ্ছিন্নতা রোধ করতে এবং দেশীয় ও বিদেশী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়তে, জাতিসত্তার পরিবর্তে নাগরিকত্বের ভিত্তিতে একটি জাতীয় পরিচয় গড়ে তুলতে চেয়েছিল। জিয়াউর রহমানের প্রশাসন বিচ্ছিন্নতাবাদের মোকাবিলায় একটি সাহসী ও কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো অঞ্চলে, যেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরার মতো আদিবাসী উপজাতি গোষ্ঠী বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাতিগত আধিপত্যের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য শুধুমাত্র ভাষাগত বা জাতিগত পরিচয়ের উপর নির্ভর করা যথেষ্ট নয়; বরং একটি সার্বজনীন জাতীয় পরিচয় প্রয়োজন, যা ধর্মীয় ও উপজাতি পরিচয়কে সম্মান করবে এবং সকল নাগরিককে একত্রিত করবে। এই লক্ষ্যে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনসংখ্যার পুনর্বাসনের একটি সাহসী নীতি গ্রহণ করেন, যা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মূল শক্তিদেরকে নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছিল।১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের প্রশাসন পার্বত্য চট্টগ্রামে ৫০০,০০০-এরও বেশি বাঙালি বসতি স্থাপন করে উক্ত অঞ্চলে জনসংখ্যার গঠনে পরিবর্তন আনে। এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য ছিল অঞ্চলটিকে জাতীয় মূলধারার সাথে সমন্বিত করা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর, যেমন শান্তি বাহিনীর প্রভাব কমিয়ে আনা। এই নীতি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করার জন্য একটি কঠোর কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা যায়, যা জিয়ার দূরদৃষ্টি ও জাতীয় ঐক্যের প্রতি অঙ্গীকারের প্রমাণ বহন করে। ফলস্বরূপ, ১৯৭৪ সালে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার মাত্র ১১.৬% বাঙালি ছিল, তা ১৯৯১ সালে ৪৮.৫%-এ উন্নীত হয়, যা অঞ্চলটির উপর জাতীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
বিভিন্ন জাতীয়তাবাদের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রাম নীতির তুলনা করলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর লক্ষ্য ভাষা এবং সংস্কৃতি (বাঙালি) ভিত্তিক ভৌগোলিক পরিচয়। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এর লক্ষ্য নাগরিকত্ব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রকাঠামোভিত্তিক যা পার্বত্য চট্টগ্রাম-র ভাষা এবং সংস্কৃতি (অবাঙালি) ভৌগোলিক পরিচয় হতে বাংলাদেশী পরিচয়ে অন্তর্ভুক্তি, কিন্তু ভারতের মদদে বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রভাব অবাঙালিদের জন্য সম্ভাব্য বিচ্ছিন্নতাকে উস্কে দিয়েছে ফলে বৈষম্যবিহীন পার্বত্য চট্টগ্রাম নীতি রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে আশার আলো দেখে নাই। বরং ফ্যাসিস্ট হাসিনার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ও ভারতের মদদে ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির মত দেশবিরোধী চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বনাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ
১৯৭৮ সালের পর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রাসঙ্গিকতা একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রের জন্য এর কৌশলগত উপযোগিতায় নিহিত, যা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং জাতীয় ঐক্য চায়। এটি ভারতীয় প্রভাব কমিয়ে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের সাথে মিত্রতা গড়ে তুলে আঞ্চলিক রাজনীতি পরিচালনা করতে সক্ষম হয়, অভ্যন্তরীণভাবে এটি বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একীভূত করার লক্ষ্য রাখে। বিপরীতে, মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ১৯৭১ সালের পর কম প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, কারণ এর ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক ঐক্যের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা অবাঙালি ভাষাভাষীদের, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে, বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকি তৈরি করে, এছাড়াও। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে মতাদর্শিক পরিবর্তন, বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, একটি বৈচিত্র্যময় জাতি-রাষ্ট্রের জটিলতা মোকাবেলায় তুলনামুলকভাবে উপযুক্ত । এছাড়াও বাঙালী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের সাথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ,ত্রিপুরা রাজ্যের ও আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকা অঞ্চলের অভিন্ন রাজনৈতিক ,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মতাদর্শ গড়ে তোলে যা ছিল উপনিবেশপূর্ব ও অপ্রাসঙ্গিক । এটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মতাদর্শ ও দর্শন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং ফলে ভারতীয় অপসংস্কৃতি ও আধিপত্যবাদ খুব সহজেই বাংলাদেশে প্রবেশ করে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে ভারতের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দাস হিসেবে গড়ে তোলে। যা স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য খুবই বিপদজনক।
মতাদর্শ ও পরিধি
বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মধ্যে মূল পার্থক্য তাদের মতাদর্শগত ভিত্তি। জাতিগত বনাম নাগরিক পরিচয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতিগত-ভাষাগত, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে শিকড়বদ্ধ, প্রায়শই অ-বাঙালি সংখ্যালঘুদের উপেক্ষা করে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নাগরিক ও ভূখণ্ডভিত্তিক, যা জাতি বা ভাষা নির্বিশেষে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে সকল নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার মূল রূপে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করেছিল, পাকিস্তানের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ইসলামী মূল্যবোধকে সমন্বিত করে, দেশটির জনসংখ্যাগত বাস্তবতা প্রতিফলিত করে এবং ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর বিরোধিতা করে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-পূর্ব সংগ্রাম থেকে বৈধতা আহরণ করে, যেখানে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ স্বাধীনতা-উত্তর জাতি গঠনের চ্যালেঞ্জের বাস্তবসম্মত প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভূত হয়।বাঙালি জাতীয়তাবাদ সাংস্কৃতিকভাবে ভারতের বাংলাভাষী অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত যা ভারতীয় কলকাতাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক আধিপত্য বাংলাদেশে বিস্তারে প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করে, যেখানে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি স্বতন্ত্র বাংলাদেশী পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে, ভারতীয় আধিপত্যবাদী বয়ানকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেয়।
বাঙালী জাতীয়তাবাদ মূলত একটি সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পরিচয়ের ধারণা, যা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাঙালীদের মধ্যে একটি সাধারণ সংযোগ তৈরি করে। পক্ষান্তরে,বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধারণা, যা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্তি ও স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। এটি বাঙালী পরিচয়ের সাথে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার মিশ্রণ। দুই মতবাদের পার্থক্যের মূল কারণ হলো সাংস্কৃতিক বনাম রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং ভৌগোলিক সীমারেখা।
বাঙালী জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে গভীরভাবে গঠন করেছে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে জাতীয় গৌরবের প্রতীক হিসেবে উন্নীত করেছে। এটি একটি তথাকথিত সাংস্কৃতিক অভিজাত শ্রেণি(বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও শিল্পী) গড়ে তুলেছে, যারা ১৯৭১-এর রোমান্টিক বর্ণনাকে ধরে রেখেছে, যা প্রায়শই ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আওয়ামী লীগের সমর্থনে এই অভিজাত শ্রেণি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে, একটি সমজাতীয় বাঙালি পরিচয়কে শক্তিশালী করেছে, যা উপজাতি ঐতিহ্য এবং এই কাঠামোর বাইরের ধর্মীয় প্রকাশকে বিচ্ছিন্ন করেছে।পক্ষান্তরে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বৈচিত্র্যময় করতে চেয়েছিল, ইসলামী ঐতিহ্য এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সংস্কৃতিসমূহ আলিঙ্গন করে। এটি একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক বহুসংস্কৃতিবাদ প্রচার করেছিল, যা ধর্মীয় অনুভূতি এবং আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে সম্মান জানায়, কলকাতা কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে। তবে, এর সাংস্কৃতিক প্রভাব সীমিত, কারণ এটি প্রতিদ্বন্দ্বী মতাদর্শের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন এবং ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তার অভাবে পড়ে আছে।
রাজনৈতিক প্রভাবসহ বাঙালী জাতীয়তাবাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ, আওয়ামী লীগের জন্য একটি একীভূত শক্তি হিসেবে কাজ করেছে,এককভাবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও আদর্শের রক্ষক হিসেবে এর দাবিকে বৈধতা দিয়েছে। এটি “মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি” বনাম “মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি” নামক একটি বয়ান টিকিয়ে রেখেছে, যা বিএনপি-জামায়াত ও ইসলামপন্থী দলগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য হুমকি হিসেবে চিত্রিত করে রেখেছিল। এই দ্বিধাবিভক্তি একটি দ্বি-দলীয় ব্যবস্থাকে স্থায়ী করেছে, যেখানে আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ক্ষমতা সুসংহত করতে ব্যবহার করেছে, প্রায়শই কর্তৃত্ববাদী উপায়ে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় উভয় নির্বাচনী শ্রেণীর মধ্যে সেতুবন্ধনের লক্ষ্য নিয়েছিল। বিএনপি’র দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক উদারীকরণ, গণতান্ত্রিক অগ্রগতি এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্রের বিপরীতে ছিল। তবে, অভ্যন্তরীণ বিভক্তি, বাহ্যিক চাপ এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠিত বর্ণনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে না পারায় এর রাজনৈতিক প্রভাব আওয়ামী শাসনকালে ব্যাপক ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদে সাফল্য ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রয়োগ
আওয়ামী লীগ, ভারত-সমর্থিত বামপন্থী দলগুলির সঙ্গে একত্রিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে এর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সফলভাবে টিকিয়ে রেখেছে। এই সাফল্য উৎসারিত হওয়ার প্রধানতম কারণসমূহ :
ঐতিহাসিক বৈধতা: স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে, আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত করে, নিজেকে বাংলাদেশের আত্মার রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করে। এই বর্ণনা জনগণের মধ্যে গৌরব ও ঐক্যের অনুভূতি জাগায়।
প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ: দলটি শিক্ষা, গণমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, জনসচেতনে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করে। পাঠ্যপুস্তক, উৎসব এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এর মাধ্যমে এই পরিচয়কে শক্তিশালী করে।
বামপন্থীদের সঙ্গে জোট: ভারত-সমর্থিত কমিউনিস্ট ও বামপন্থী গোষ্ঠী, ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংযুক্ত, এর ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক বক্তব্যকে সমর্থন করে এবং সমমনা বুদ্ধিজীবী ও শহুরে অভিজাতদের আকর্ষণ করে।
সাংস্কৃতিক অভিজাত সূত্র: আওয়ামী লীগ একটি “সাংস্কৃতিক অভিজাত”—সাহিত্যিক, কবি এবং শিক্ষাবিদ—গড়ে তুলেছে, যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি প্রগতিশীল আদর্শ হিসেবে বয়ান তৈরি করে। এই অভিজাত শ্রেণি, প্রায়শই বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের বাস্তবতা হতে বিচ্ছিন্ন।
বিএনপি’র প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রয়োগে ব্যর্থতা
বিএনপি, ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ হতে উদ্ভূত হয়। জিয়াউর রহমান , ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষক, একজন জাতীয় বীর ও তৎকালীন রাষ্ট্রনায়ক, একটি জাতীয়তাবাদের কল্পনা করেছিলেন যা ভিন্ন জাতিসত্ত্বাকে(ethnicity) অতিক্রম করে বিচ্ছিন্ন জাতিকে একত্রিত করবে। দলের ১৯-দফা কর্মসূচি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্র এবং আত্মনির্ভরতার উপর জোর দিয়েছিল, যা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। জিয়াউর রহমানের সাংবিধানিক সংশোধনী এবং ইসলামী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন আওয়ামী লীগের নীতি থেকে একটি সাহসী বিচ্যুতি নির্দেশ করে, বিএনপিকে একটি মধ্য-ডান বিকল্প হিসেবে অবস্থান করায়। বিএনপি প্রাথমিকভাবে নির্বাচনে সফল হয়, ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে জিয়াউর রহমানের পত্নী ও সুযোগ্য উত্তরসূরী আপোসহীন দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতা অর্জন করে। এর নীতি—মুক্তবাজার সংস্কার, জনশক্তি রপ্তানি এবং অবকাঠামো উন্নয়ন—বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বাস্তববাদী চেতনাকে প্রতিফলিত করে, ব্যাপক সমর্থন অর্জন করে।তবে বিএনপি দলের মূল আদর্শ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করতে ও প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি খোদ বিএনপিতেই এর বিপরীত চেতনার মানুষের আনাগোনা বেড়ে গেছে, এর কারণঃ
সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অভাব: বিএনপি আওয়ামী লীগের বাঙালি-জাতীয়তাবাদী অভিজাত শ্রেণির বিরুদ্ধে একটি গণমুখী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক প্রতি-বর্ণনা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। এর সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের জন্য বুদ্ধিজীবী ও শৈল্পিক অবকাঠামোর অভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আধিপত্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী থেকে যায়।
রাজনৈতিক বিভক্তি: বিভিন্ন মতাদর্শের সমন্বয়ে গঠিত বিএনপি’র জোট এর মতাদর্শগত সংগতি ক্ষুণ্ণ করে। অভ্যন্তরীণ বিভেদ এবং মিত্রদের উপর নির্ভরতা এর একীভূত ফ্রন্ট উপস্থাপনের ক্ষমতাকে দুর্বল করে।
কর্তৃত্ববাদী প্রতিক্রিয়া: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন, নির্বাচনে কারচুপি এবং দমনের অভিযোগের পর, বিএনপি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ২০১৮ সালে খালেদা জিয়ার কারাবাস এবং ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন দলটির রাজনৈতিক প্রভাবকে ক্ষুণ্ণ করে।
আওয়ামী ও ভারতীয় প্রতিরোধ: ঐতিহাসিক বৈধতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে “মুক্তিযুদ্ধবিরোধী” হিসেবে চিহ্নিত করে এর বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করে। ভারতের আওয়ামী লীগের প্রতি নীরব সমর্থন বিএনপি’র প্রভাবকে আরও সীমিত করে। ফলে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে থেকে যায়, বাস্তব সাংস্কৃতিক জীবনে রূপ না নিয়ে, আওয়ামী লীগের বয়ানের ছায়ায় পড়ে শাখা মতবাদ হিসেবেই রয়ে যায়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবনতি
বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা আওয়ামী লীগ এবং ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, ২০২৪-এর পর উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। ২০২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডিতে ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নং রোডের বাসভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া, যা পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নির্বাসন থেকে দেশবিরোধী বক্তৃতার পর-প্রতিক্রিয়া হিসেবে জনগণের অসন্তোষের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এই ঘটনায় বিক্ষোভকারী ছাত্রজনতা ভবনটি ধ্বংস করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, যা পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসন এবং এর বাঙালী জাতীয়তাবাদী আখ্যানের নামে ভারতের গোলামীর বিরুদ্ধে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের নিন্দা বিবৃতি, যা বাংলাদেশী পরিচয়ের পরিবর্তে “বাঙালী পরিচয়ের এর অহংকার” লালন করার ক্ষেত্রে ভারতের নগ্ন ভূমিকা তুলে ধরে। তবে দেশীয় বিরোধিতা এই পরিচয়ের প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত দেয়। এছাড়াও, অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক নিযুক্ত সংবিধান সংস্কার কমিশন মৌলিক নীতিগুলি থেকে “ধর্মনিরপেক্ষতা,” “সমাজতন্ত্র,” এবং “বাঙালী জাতীয়তাবাদ” মুছে ফেলার প্রস্তাব করেছে, তাদের পরিবর্তে “সমতা” “মানবিক মর্যাদা” “সামাজিক ন্যায়বিচার” এবং “বহুত্ববাদ” দিয়ে প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে রিপোর্ট করা এই প্রস্তাবটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে দূরে সরে যাওয়ার একটি আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নির্দেশ করে, যা মূল সংবিধানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোর দিকে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উত্থান
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ২০২৫ সালে আরও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করছে। বিএনপি, যা এই মতাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত, একটি ভূখণ্ডগত পরিচয় প্রচার করে যা জাতি, লিঙ্গ বা বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাংলাদেশীর অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়, যা তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং সম্প্রতি বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা প্রদর্শন করেছে, যা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানের পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে হিন্দু মন্দিরে আওয়ামীপন্থীদের আক্রমণের ঘটনা বৃদ্ধি পেলে, জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু ইসলামপন্থী গোষ্ঠী মন্দির পাহারা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। এটি প্রাথমিকভাবে একটি প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা গেলেও, এর মাধ্যমে তারা সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতি ও সুরক্ষার বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, যা তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি প্রসারিত করার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। এই কর্মকাণ্ড ধর্মীয় গোঁড়ামির অভিযোগ থেকে নিজেদের দূরে রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনোভাব গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে।
অন্যদিকে, হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইসকন কর্তৃক চট্টগ্রামে আলিফ নামে একজন তরুণ আইনজীবী হত্যার ঘটনা(যিনি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে নিহত হন) ইসলামপন্থীদের জন্য আরেকটি পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই ঘটনায় ইসলামী দলগুলো দ্রুত নিন্দা জানিয়ে শান্তি ও সহাবস্থানের আহ্বান জানিয়েছিল। এটি তাদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার একটি উদাহরণ, যেখানে তারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য দায়ী হওয়ার অভিযোগ এড়াতে এবং মূলধারার রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে কৌশলগতভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে। এই ধরনের ঘটনায় ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদরা ধর্মীয় পরিচয়ের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার চেষ্টা করেছে, যা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সার্বজনীনতার বহিঃপ্রকাশ।
এছাড়াও, চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে এই জাতীয়তাবাদের প্রাসঙ্গিকতা বিশেষত যেখানে আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যারা জাতিগত বাঙালি নয়, ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন বোধ করেছে তাদের ক্ষেত্রে স্পষ্ট। ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তি ভূমি অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসন মোকাবেলা করার লক্ষ্যে ছিল, কিন্তু এর অসম্পূর্ণ বাস্তবায়ন চলমান উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, এর অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে, এখানে আরও গতিশীল ও কার্যকরী হতে পারে, যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের বহুত্ববাদের প্রতি মনোযোগ, সমকামী অধিকার বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ও মার্কিন স্বার্থোদ্ধার এর দুরিভিসন্ধি এই মতবাদ প্রচারে নতুন বাধা সৃষ্টি করতে পারে। জনমত এবং রাজনৈতিক গতিশীলতা যদিও বাঙালি বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে জনমতের উপর নির্দিষ্ট, বিপ্লব পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মূলত বিভিন্ন দিকে মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের ২০১৪,২০১৮,২০২৪ সালে নির্বাচন কারচুপি ও ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালে পরপর দুইটি গণআন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যা পূর্ণতা পায় ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব দ্বারা, যা ছিল আগের দুই আন্দোলনের তুলনায় আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক । আন্দোলনগুলোর মূলভিত্তিই ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং এর সমর্থনে গড়ে ওঠা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের অবসান। বিএনপি- ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে সক্রিয় ভূমিকা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উত্থানের জন্য ক্রমবর্ধমান সমর্থনের ইঙ্গিত দেয়।
S. M. Moinull Hossain
S. M. Moinull Hossain is a graduate in Leather Engineering from the University of Dhaka. This research enthusiast young professional is a Bangladeshi nationalist, by ideology, and an engineer by profession. He is serving as the Publication Secretary of IBRR. Previously, he served as the President (Founding) of Arjon Bus, University of Dhaka. Besides, he is the Founder of ILET Designers, Engineers, Photographers, Origamists, Technologists (ILET DEPOT); and Founder of the Dhaka University Skill Development Club.
এই ধরণের আরো...
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial