আজ আপনাদেরকে হৃদয় ভেঙ্গে দেওয়া একটা গল্প বলব। তার আগে, বিনীত অনুরোধ: গল্পটিকে শুধুই রাজনৈতিক লেন্স দিয়ে না দেখে, ব্যক্তি-দৃষ্টিভঙ্গিতে একটু ভেবে দেখবেন। বর্তমান জমানার একটা অশুভ প্রবণতা হচ্ছে__ প্রতিটি ঘটনা আমরা নিজস্ব রাজনৈতিক লেন্স দিয়ে দেখি। একইরকম ঘটনা আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে একরকম ভাবি, পক্ষে গেলে ভাবি অন্যরকম। রাজনৈতিক চশমার কারণে একই ঘটনার মধ্যে আমরা একেকজন একেক রকম ন্যারেটিভ খুঁজে পাই। আর নিজ নিজ রাজনীতির ন্যারেটিভের চশমার আড়ালে ঢাকা পরে যায় আসল সত্য।
এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে আমি আপনাদের নিকট বিনীত অনুরোধ করছি; ন্যারেটিভের চশমা খুলে, একটু আজকের গল্পটা নিরপেক্ষ নয়নে ভেবে দেখি, চলুন।
আমার বন্ধু জালাল চট্টগ্রামের পেকুয়া উপজেলার এক বীরগর্ভা মায়ের সন্তান। নিম্নমধ্যবৃত্ত পরিবারের শিক্ষার আলোপ্রাপ্ত জালাল একটা ’আশার মশাল’ হিসেবে বেড়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পায়, পরপর দুইবার। পরিবারের স্বপ্ন__ সংসারের হাল ধরবে জালাল। জ্বালালের স্বপ্ন__ বিসিএস ক্যাডার হবে।
২০১৩ সালে সরকারি চাকরিতে ৫৬% কোটার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে সদ্য-কৈশোর পেরুনো টগবগে তরুণ জালালের আবেগী মন। আন্দোলনের প্রথম সারিতে মিছিল নিয়ে মার খায়। মার খেয়ে মতি ঘোরে_ রাজনীতি করবে। কারণ__ রাষ্ট্রের দলনিরপেক্ষ সেবাবিভাগের (সরকারি চাকরিতে) নিয়ন্ত্রণ নিতে রাজনীতি যেভাবে ক্রিয়াশীল ছিল, তার সমাধান অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হতে পারে বলে আস্থা হারিয়েছিল জালাল। ফলে, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সৈনিক হিসেবে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে সে। টু-পাইস কামানো বা ধান্ধাবাজি জালালের ডিকশনারিতে যে ছিল না__ এইটুকু আমি অনুভব করেছি তার চোখমুখে তাকিয়েই। ২০১৪ সালে আমরা যখন স্নাতকের কোনো কোর্সে কত নাম্বার তোলা যায়, তার হিসেব করতাম, জালাল তখন হিসেব করতো, কোন পথে কত লোক জমিয়ে ‘ঢাকা অচল’ করে দিয়ে হাসিনাকে ফেলে দেওয়া যায়। ‘সহিংস আন্দোলনের মাস্টার প্লান’ নিয়ে আটক হয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় কারাবরণ করে।
সুদীর্ঘ ১১ মাসের কারাবাস জালালকে জ্বালাময়ী জালালে রূপান্তরিত করে। পরিবার ও পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্নতা, বৈদ্যুতিক শক-সহ নানা প্রক্রিয়ায় নিপীড়ন জালালকে মানসিকভাবে আহত করে। আহত জালাল দমে যায়নি। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু, কিছু কিছু আঘাত মানুসের মন ও মস্তিষ্ককে এমনভাবে ক্ষত-বিক্ষত করে যে তা আর উপশম করা যায় না।
জালালের স্থানে নিজেকে চিন্তা করেন। এতো এতো অবদান রাখার পরেও গণঅভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশে জালাল কোনো চাঁদাবাজিতে জড়ায়নি। জালাল কোনো নিয়োগ-বাণিজ্যে জড়ায়নি। জালাল শুধু চেয়েছিল: মুক্ত বাংলাদেশে তার যেটুকু অধিকার, সেই অধিকারটুকু নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে পড়াশোনাটা শেষ করতে। জালালের যে অবদান, সেইটুকু ব্যবহার করে সে কিন্তু পদ-পদবি বাগিয়ে নিতে পারতো। সেটা না করে, জালাল নেমেছিল ‘চাকরি সংস্কার আন্দোলন’ করতে। অসম প্রতিযোগিতার সুবিধা না নিয়ে সুষম প্রতিযোগিতায় বিসিএস-এর প্রার্থীও হতে চেয়েছিল জালাল (আমার কাছ থেকে পড়াশুনার পরামর্শও নিয়েছিল)। ওর সাথে শেষ যেদিন দেখা হয় ( ১৫-২০ দিন আগে), সেইদিনও বলেছিল, “বন্ধু, বিসিএস তো আমি দেবো।”
অপরদিকে, গণঅভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশের তরুণদের মনে কাউকে না গোনায় ধরার যে উত্তরাধুনিক ঢেউ বয়ে গেছে, তার সাথে জালালের প্রত্যাশার সংঘর্ষ ঘটে। তার ওপর আছে ক্যাম্পাসে নানা-মাত্রিক রাজনৈতিক চাল-প্রতিচাল। কাকে ডাউন করে কে উঠবে, এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা পেয়েছে যেন।
আটক থাকাকালীন বৈদ্যুতিক শক, আন্দোলনে মাথায় আঘাত, জীবন বিপন্ন__ সবমিলিয়ে জালালের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা বিশেষ ভালো না। সে কিছু থেরাপিও নিয়েছে। কিন্তু, আর্থিক সঙ্কটের কারণে পূর্ণ চিকিৎসা করাতে পারেনি। সাংবাদিকতার সামান্য একটা চাকরিতে তার পড়ালেখার খরচ মেটাই ভার।
আমি তাকে বলেছিলাম: সরকারের সহায়তায় চিকিৎসা নিতে। জালাল রাজী হয়নি। নিজের চিকিৎসা নিতে সরকারি পয়সা নিতে নিজের কাছে নিজেকে ছোটো লাগে তার। এই ছিল জবাব।
এই হলো আমার বন্ধু জালাল। বেশ কিছুদিন হলো তার রুমমেটের সাথে খুব ছোট খাটো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব। আমি বলেছিলাম, হল ছেড়ে দিয়ে একটা বাসা নিতে। কিন্তু নির্বাচন করবে বলে হলে থাকাকে দরকারি মনে করছিল সে। এরই মধ্যে খবর পেলাম: জালাল আটক। শুনলাম, একটা লাইট বাল্ব না কি দিয়ে রুমমেটকে আঘাত করেছে সে, আর তার রুমমেটও রক্তাক্ত করেছে তাকে। এই কারণে, হলে মব সৃষ্টি করতে তাকে মারতে উদ্যত হয় একটা গ্রুপ। পরে, প্রভোস্ট এসে পুলিশের হাতে তুলে দেয় জালালকে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে আবারো গ্রেপ্তার হয় জালাল।
এই বেলায় অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখা শেখ মুজিবের একটা গল্প মনে পড়ছে। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুজিব আয়োজন করেছিল, “দক্ষিণ বঙ্গ পাকিস্তান কনফারেন্স”। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা বলে মারও খেয়েছেন কয়েকবার। সেই মুজিবকে যখন কারাবরণ করতে হলো, আর ফেরারির মত ছুটে বেড়াতে হলো গ্রেপ্তার এড়িয়ে, তখন তা অনেককেই অবাক করেছিল। ১৯৫২ সালে একদিন মুজিব পশ্চিম পাকিস্তান হতে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসে। খুলনায় পৌঁছুলে মুজিবকে একলোক প্রশ্ন করে (যাকে মুজিব পাকিস্তানের জন্য দাওয়াত দিয়েছিল): “এই তোমার পাকিস্তান?”
মনে রাখবেন, জালালকে রক্ষা না করতে পারলে এই দেশে আর জালালরা দুঃসময়ে দেশের পতাকা হাতে নেওয়ার সাহস করবে না।
আর, তা না করলে, আবারো যদি কখনো বাংলার বুকে জুলাই নামে, বাংলাদেশ হারিয়ে যাবে ইতিহাসের অতলে।