“ওরে ও চাষার পো, শরতের শেষে সরিষা রো।”
এটি একটি খনার বচন। উক্ত বচনে খনা বলতে চেয়েছেন, শরৎ কালের শেষে সরিষা রোপণের জন্য উত্তম সময়। খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক ছড়া। বাংলাদেশের আবহাওয়া, পরিবেশের উপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে তিনি এই ছড়াগুলো তৈরি করেছেন। কখন কোন ফসল উৎপাদন করতে হবে, কখন ধান ক্ষেতে পানি দিতে হবে, কখন ফসল তুলতে হবে ইত্যাদি বিষয় তার ছড়ায় ঠাঁই পেয়েছে। বাংলাদেশের কৃষিকাজে বাস্তবিক অর্থে সেই ছড়াগুলোই প্রতিফলিত হয়।
খনার বচনগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি, ষড়ঋতুর এই দেশে আমাদের দেশের কৃষিসহ বিভিন্ন কাজ মূলত ঋতু নির্ভর। আবহাওয়া জনিত কারণে ঋতুর সাথে সাথে এদেশের মানুষ তার কর্ম নির্ধারণ করে এসেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় নির্বাচনগুলোর অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ের দিকে খেয়াল করলেও দেখা যায়, প্রায় সবগুলো নির্বাচন হয়েছে শীতকালে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে। কারণ, শীতে আবহাওয়া শান্ত থাকে, ভোটের সারিতে ভোটারদের দাঁড়িয়ে থাকতে ভোগান্তি হয় না, ভাটির দেশ হওয়ায় ভোটকেন্দ্রে যেতে ভোগান্তি হয় না, তাছাড়া সরকার যেহেতু জুনে বাজেট প্রকাশ করে তাই, জনগণের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে একটি বাজেট প্রণয়নে যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় ইত্যাদি। একারণে, দেশের ইতিহাসে মোট বারোটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দশটি নির্বাচনই হয়েছে শীতকালে। এই দশটি নির্বাচনের শেষ তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে এবং সেই নির্বাচনগুলো ছিলো নিয়মরক্ষার, কারচুপি ও রাতের ভোটের। হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, সেই নির্বাচনগুলোতে ভোটার অংশগ্রহণের কোন প্রয়োজনই পলাতক শেখ হাসিনার ছিলো না, তবুও তিনি নির্বাচনগুলো শীতকালে দিয়েছিলেন।
বাকি দুইটা হল তৃতীয় ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তৃতীয়টি অনুষ্ঠিত হয়, গরমকালে, ১৯৮৬ সালে। স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে এই কারচুপির নির্বাচনটিতে বিএনপির মতো জনপ্রিয় ও বৃহৎ দল অংশগ্রহণ করেনি। আর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় জুন মাসে। ব্যতিক্রম যেহেতু উদাহরণ হতে পারে না তাই বলাই যায়, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কাল শীতকাল।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা দিয়েছে, আগামী বছর এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন। প্রচণ্ড দাবদাহ ও কালবৈশাখী ঝড়ের এই সময়টায় দেশের ইতিহাসে শুধু একবারই নির্বাচন হয়েছিলো, সেটি স্বৈরাচার এরশাদের সময়ে – মে মাসে। যা পূর্বে উল্লেখ করেছি।
এপ্রিল মাস কোনভাবেই জাতীয় নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয়। কারণ__
এপ্রিলে নির্বাচনের হলে, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বাজেট তৈরির জন্য মাত্র এক থেকে দুই মাস সময় পাবে। যা একটা দেশের বাজেট তৈরির জন্য যথেষ্ট সময় না।
ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও জনপ্রিয় দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আগামী নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভ করবে। জনগণের প্রতি এই দলটির কিছু প্রতিশ্রুতি থাকবে, কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশের বাজেট তৈরিতে তাকে হিমশিম খেতে হবে, যা পরবর্তীতে দেশের স্থিতিশীলতায়, শক্তিশালী সরকার গঠনে, উন্নয়নে এবং দলটির জনপ্রিয়তায় প্রভাব ফেলতে পারে।
কিছুদিন পূর্বে এনসিপি নেতা সারোয়ার তুষার, যিনি নারী নির্যাতনে অভিযুক্ত, তিনি পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে দেড় বছরের মধ্যে উৎখাতের হুমকি দিয়েছিলেন। যারা ইংরেজি ডার্ক সিরিজ দেখেছেন তারা জানেন যে সেখানে বলা হয়েছে, সবকিছুই সবকিছুর সাথে সংযুক্ত। অনেক নেটিজেন মনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে এপ্রিলে নির্বাচন দেয়ার কারণ কি বাজেট তৈরিতে বিএনপিকে জটিলতায় ফেলা এবং সরকারকে দুর্বল করা এবং সারোয়ার তুষারের সেই বক্তব্য কি এটা জেনেই দেয়া? তাহলে কি ডার্ক সিরিজের মতো জনাব তুষারের বক্তব্য এবং এপ্রিলের নির্বাচনের মধ্যে কোন সংযোগ আছে? এছাড়া এই সরকারের মধ্যে থাকা কিছু উপদেষ্টার মধ্যে ‘বিএনপি ঠেকাও’ প্রবণতার কারণে জনমনে এমন আরও প্রশ্নের উদ্রেক করছে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের প্রচারণার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ৪৫ দিন সময় দেয়া হয়। কিন্তু এপ্রিলে প্রথমার্ধ অর্থাৎ ১৫ তারিখের আগে নির্বাচন হলে দেখা যায়, ২০ মার্চ রমজান ঈদ হতে পারে। সেক্ষেত্রে, ঈদের পর প্রচারণার জন্য পাওয়া যায় মাত্র ২৫ দিন। বাকি বিশ দিন প্রচারণা চালাতে হবে রোযার মধ্যে। গরমকালের রোযা রেখে এই শারিরীকভাবে কষ্টসাধ্য প্রচারণার কাজ সম্ভব নয়। জনগণও পছন্দ করবে না।
এপ্রিল মাস বাংলাদেশের বোরো ফসল ঘরে তুলবার মৌসুম। ঐ সময়টার প্রতিটি সেকেন্ড কৃষক-কৃষাণী, এই ফসল সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা নানান শঙ্কা, অনিশ্চিতয়তার মধ্যে কাটায়। কখন শিলাবৃষ্টি হয়, কখন বেড়িবাঁধ ভেঙে ফসল ডুবে যায়, কখন কালবৈশাখী ঝড়ে টানা বৃষ্টি শুরু হয়ে ধান শুকাতে সমস্যা সৃষ্টি করে, কখন মেঠো পথ কর্দমাক্ত হয়ে ধানের দর কমে যায় তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই, গ্রামের প্রতিটি মানুষ সেসময় ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটায়। মাঠেঘাটে দিন-রাত থাকে ধানের কাজকর্ম নিয়ে।
এই সময়ে নির্বাচন হলে, হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড় যেমন ভোটের পরিবেশ নষ্ট করে ফেলতে পারে, তেমনি এপ্রিলের গরমে মানুষজনকে ভোটের সারিতে দাঁড় করিয়ে রাখাটা রাষ্ট্রের অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। বিশেষ করে রাজশাহী চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে কী পরিমাণ গরম এই মাসটায় পড়ে তা সকলেই অবগত আছেন।
এছাড়া এপ্রিল মাসে এইচএসসি পরিক্ষা হবে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিক্ষার সময়ে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী এবং তাদের পিতা-মাতার উদ্বিগ্নতার সময়ে নির্বাচন দেয়াটা মোটেও যৌক্তিক নয়। নির্বাচন একটি উৎসব এবং আগামীর ভবিষ্যৎদের জন্য গণতান্ত্রিক শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা। এই লাখো শিক্ষার্থীদের এই উৎসব ও অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত করা রাষ্ট্রের উচিত হবে না।
ঈদুল ফিতরের মাত্র বিশ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে শহরের অবস্থান করা গ্রাম-মফস্বলের ভোটাররা এই ছুটির পর বাড়ি নাও আসতে পারেন, তাদের কর্মস্থান পর্যাপ্ত সময়ের জন্য ছুটি দিতে না পারে। অনেক তাড়াহুড়োটা মানুষ এড়িয়ে যেতে পারে, নিম্ন আয়ের মানুষজন ঈদের খরচের পর ভোটের জন্য খরচাপাতি করে এলাকায় যাতায়াত করতে অনীহা প্রকাশ করতে পারে। মানুষ দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে ভোট দিতে পারছেন না। তাই, সর্বোচ্চ মানুষ যেন এই জাতীয় নির্বাচনের ভোট দিতে পারে, সেই সুযোগ এই সরকারকেই সৃষ্টি করতে হবে।
আগামী নির্বাচনটা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় নির্বাচন। তাই আবহাওয়া, পরবর্তী সরকারকে বাজেট প্রধানে পর্যাপ্ত সময় দেয়া, ভোটারসহ সকল জনগণকে উৎসবমুখর পরিবেশ উপহার ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারীর মধ্যে এই সরকারকে নির্বাচন দেয়া উচিত। তা নাহলে, ভোট কাস্টিং কম হওয়া থেকে শুরু করে নানানরকম নেতিবাচক প্রভাব এই নির্বাচনে পড়বে, এমনকি নির্বাচনটাও অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে।
এপ্রিলে নির্বাচন ঘোষণা করায় উক্ত কারণগুলোর কারণে ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক দলগুলো বিশেষত বিএনপি উক্ত কারণগুলোর কারণে এপ্রিলের নির্বাচন নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে এবং এই জনবিচ্ছিন্ন সরকার ও অনির্বাচিত সরকার যদি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জনসম্পৃক্ত দলকে আস্থায় না নিয়ে, সন্দেহপ্রবণ করে তুলে তাহলে এই সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। কেননা, এই সরকারের প্রধান রাজনৈতিক ‘ব্যাকআপ’ বিএনপি।
তাছাড়া, বাংলাদেশকে নিয়ে পতিত স্বৈরাচার, নৈরাজ্যবাদীরা বিদেশি শক্তি নিয়ে যে ধরণের দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সেটি শুধু নির্বাচিত সরকারই রুখতে পারে। তাই, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, জনগণ বিশেষত নারীদের নিরাপত্তা, বিনিয়োগের পথ সুগম এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। তাই, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন প্রয়োজন।