একদল ‘খিলজি’ বংশের তুর্কি আসে
হিন্দুকুশের পাদদেশে পাঠানদেশে,
সেখানে তুর্কি মায়ের ঘর আলো করে
এক দিগি¦জয়ী বীর জন্মলাভ করে।
তিনি ঘোরীর দলে দিল্লি জিতিয়া
নিজবলে দখল করিলেন নদীয়া;
নিজনামে জন্ম দিলেন সালতানাত,
বাংলাদেশে উদিল নতুন প্রভাত।
নতুন আশার দিশারী ইখতিয়ার
তিব্বতে অভিযানে ছাড়লেন সংসার।
শেষে শিরান খিলজি শাসন নিলেন,
তারপরে মর্দান- ইওয়াজ এলেন।
তারপরে বাংলা দিল্লির দখলে গেল;
আর তাতে তুর্কি নিশান উড়িয়া গেল।
তবু তুর্কির চিহ্ন রইল ইতিহাসে,
এ গান গাইল আজাদ ঢাকায় বসে।
খিলজি মালিকদের অন্তর্দ্ব›েদ্বর সুযোগে
বাংলাশাহীর আজাদী যায় মায়ের ভোগে,
দিল্লীশাহ ইলতুতমিশ বাংলার দখল নিয়া,
ঘোষণা করিয়া দিল ‘প্রদেশ’ বলিয়া;
‘প্রদেশ নয় দেশ’ রবে ওঠে বিদ্রোহী সুর
বাংলাদেশের পরিচয় হয় ‘বুলগাকপুর’।
দিল্লিশাহী হতে স্বাধীন হয় সোনারগাঁও,
পরপরই মুক্তি পায় গৌড় ও সাতগাঁও;
তিন পুরের মিলনে ওঠে নতুন প্রভাত:
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা সালতানাত।
বিদ্রোহের কালেও চলে সুফিঋষির সাধনা;
রাজা একে আজাদ গাইল তার বন্দনা।
(i) কাদেরিয়া দরিয়া
সর্বহালে খোদার শুকর সর্বহালে জিকির তার,
এই তরিকায় মেলে মোকাম, মওলার দিদার।
আব্দুল কাদির জিলানীর এই মুক্তির গান
দিল্লিশাহীর কালে বাংলায় আনলেন শাহ তুরকান।
বাগদাদ হতে বরেন্দ্র তক বইল এক দরিয়াÑ
আব্দুল কাদির জিলানির সিলসিলায়ে রুহানিয়া;
তুরকান শাহ শহিদ হলেন প্রেমের গান গেয়ে,
শাহ মখদুম রুপস এলেন তাঁরই পথ বেয়ে।
এই ধারায় আরো আসেন শত সাধু মুর্শিদ
রাজা এ.কে.আজাদ গাইছেন সেই গীত।
(ii) চিশতিয়া দরিয়া
জিকিরের সাথে ইশক মেশাও দিল ভরিয়া,
খোদার সব বান্দারে মহব্বতে লও বরিয়া।
খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর এই প্রেমের মালা
দিল্লীশাহীকালে বাংলায় আনলেন মখদুম দৌলা,
শামস তাব্রিজীর তাবিজ নিয়া এলেন চলনবিল,
পথের হলো চিশতিয়া নদীর সাথে তাঁর মিল।
একই প্রেমের বাতি নিয়ে এলেন আলাউল হক,
সুলতানদের দীক্ষা দিয়ে দেখালেন রুহানি ঝলক।
নূর কুতুব এই আলোতে গণেশকে বশ করে,
তার ঝলকে জালালশাহ ইসলাম গ্রহণ করে।
চিশতিয়া রুহানি দরিয়ায় ঘটে বহু বাজিমাত:
খাজার গান গাইল কবি রাজা একে আজাদ।
(iii) সোহরাওয়ার্দীয়া-জালালিয়া দরিয়া
খ্রিস্টীয় তের শতকের এক কাকডাকা সকালে
গরু খেয়ে শহিদ হলো মুসলমানের ছেলে।
রাজা গৌর গোবিন্দের হাতে শিশুর রক্ত;
ঘনিয়ে আনলো সিলেটের তখতে তার অক্ত।
তিনশত ষাট সুফি-দরবেশ সঙ্গে নিয়া
শাহ জালাল বাতি জ্বালালেন রুহানিয়া,
সেই বাতিতে গৌর গোবিন্দের ঘর পুড়ল,
বাগদাদ হতে সিলেট তক এক নদী বইলÑ
সোহরায়ার্দীয়া নূরের ঝলকে জ্বলল অন্তর;
জালালিয়া সেন্টারে জাগল জালালি কইতর।
সুরমা-বরাকের তীরে জাগল রুহানি আনন্দÑ
সেই রঙ্গে গান গায় রাজা আজাদ আখন্দ।
(iv) বিবিধ স্রোত
বৌদ্ধযুগে পীর বায়জিদ এলো বোস্তাম হতে
আদম শহিদ বঙ্গে এলেন সেনের আস্তানাতে।
তার ¯্রােতে সুলতান বলখি এলো বগুড়ায়,
আর শাহ সুলতান রূমি এলো নেত্রকোনায়।
স্ব›দ্বীপের আশপাশ হতে জ্বিন তাড়াতে গিয়া
চাটি জ¦ালালেন জ্বালালেন বদ আউলিয়া।
চাটির আলো জ্বলা গ্রামগুলোর হলো নাম:
চাটিগাঁও, আর তা হতে চাটগাঁ ও চট্টগ্রাম।
খিলজি খেলের পূর্ব হতেই এলেন সাধকেরা,
দিল্লীশাহীর কালে বাড়ল তার ¯্রােতধারা,
সুলতানি যুগের সমস্ত জুড়ে এ ধারা বহমান;
তার সুরে রাজা আজাদ আখন্দ গাইছে গান।
দিল্লিশাহী করতল হতে আজাদীর এলানে
মোবারক শা বসেন সোনারগাঁর রাজাসনে।
তার পথ ধরে সমগ্র বাংলা দখল করে
শামসুদ্দিন ইলিয়াস উঠলেন রাজশিখরে।
তিনি তকমা নিলেনÑ শাহ-ই-বাঙ্গালাহ
নতুন প্রভাত উঠল দেশে- মাশাআল্লাহ।
বাঙালি জাতি ঐকতানে পরিচয় পেল,
জাতিগঠনের এক সুযোগ লাভ করল।
সিকান্দারের তখতে পোক্ত হল সালতানাত,
গিয়াসের কালে সাহিত্য পেল শওকাত।
শাহ সগীর কাব্যে লিখলেন ইউসুফ-জোলেখা,
কবি হাফিজ চিঠি পেলেন সুলতানের লেখা।
আবু তাওয়ামার উত্তরাধিকার দানিশমন্দে
কোরান-হাদিসের আলো ছড়ালেন আনন্দে।
মাহমুদ শা’র করতলে যখন বাংলাজাহান
বাগেরহাটে নগর গড়েন তখন খানজাহান।
সুলতানের ছায়ায় পীরেরা ধর্মাচার চালায়,
পীরের খানকায় শূদ্র-বৌদ্ধ একথালায় খায়,
ডালু-কোল-বামুন-চাড়াল হইয়া মুসলমান,
বিবাহে-বিবাহে পরস্পরে মিশিয়া যান।
বাঙালি জাতি নয়ারূপ পায় ইলিয়াসী বাংলায়,
রাজা একে আজাদা আখুন্দ লিখিয়া যায়।
চর্যাপদে লেখা হতো আত্মচর্চার গান
সেসব ছিল বৌদ্ধধর্মের দ্বীনী-বয়ান।
পরে নতুন সুর আনে বড়– চÐীদাস
রাধাকৃষ্ণের গানে মানুষের আভাস।
পূর্ণাঙ্গ মানুষের গান গেয়ে মুহম্মদ সগীর,
বাঙালির চোখে ছবি আঁকেন ইউসুফ নবীর।
চÐীদাসের রাধাকৃষ্ণের গানে যেই সুর বাজে,
ফারাক নাহি রয় ইউসুফ-জোলেখার মাঝে।
‘রসুল বিজয়’ কাব্যে জৈনুদ্দিন আঁকেনÑ
মানুষরূপে নবি মুহম্মদ কেমন ছিলেন।
বাংলা সাহিত্য বদলায় বিপ্লবী আছড়ে
কবিরা মানুষকে আঁকেন, পুরান ছেড়ে।
কে বিচারিবে এ বিপ্লবে কী ভালো-মন্দ,
ভীষণ দ্বিধায় পড়িল রাজা আজাদ আখন্দ।
মুসলিম সুলতানি শাসনের মাঝে হঠাৎ
বাঙালি লভিল রাজা গণেশের সাক্ষাৎ
মুসলমানরাজ হতে শাসন হাতে নিয়া
মূর্তিভাঙার দাঁদ নিলেন মসজিদ ভাঙিয়া
গণেশের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন নূর কুতুব,
রাজা বোধ হয় ভয়ই পেলেন তাতে খুব।
রাজপুত্র যদু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়া,
শাসন নিলেন ‘জালালুদ্দিন’ নাম নিয়া।
মসজিদ মেরামত করে, মন্দির ভেঙ্গে,
গণেশের পুত্র মুসলমানের সমর্থন মাঙ্গে।
কীসের আবেশে যে বদলাল তার বোলÑ
রাজা আজাদ বলেÑ ই বড় বিষম গÐগোল।
(i) চৈতন্যের মন্ত্র
কৃষ্ণের প্রেমে রাধা যেমন
¯্রষ্টার প্রেমে সৃষ্টি তেমন।
প্রেমেই স্বর্গ-মর্ত্য-মুক্তি
প্রেমের প্রমাণ হলো ভক্তি।
এ মন্ত্র আনলেন চৈতন্য;
এ বয়ানে কবিরা ধন্য,
হাবশি ও হোসেনী কালে
এই সুর বাজলো ভ‚তলে।
এ সুরের মোহে মজিয়া,
আজাদ চলিলেন গাইয়া।
(ii) বৈষ্ণব সাহিত্য
রাধাকৃষ্ণের যে ধামালি লেখেন বড়– চÐীদাস,
তার মাঝে প্রেম মেশালে হয় পদাবলির চাষ;
এই আবাদেই ফসল ফলান কবি চÐীদাস,
বিদ্যাপতি, জয়দেব, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস।
লোচন ও বৃন্দাবন জ্বালান চৈতন্যের আলোÑ
তার সুরে মানুষের গানে জ্ঞানদাস বলে গেলÑ
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেলÑ
বৈষ্ণবের এ সুর বাংলা সাহিত্যের ফুল ফুটালো।
হোসেনশাহী সালতানাতের এ বৈষ্ণবী সুরে,
রাজা আজাদ গাইলেন গান চাটগাঁ-রংপুরে।
(iii) ধর্ম ও সাহিত্যের ¯্রােতমিশ্রণ
হোসেনেশাহী জমানা হতেও বহুকাল পরে
ঋষি ও কবিরা মাতলেন রাধাকৃষ্ণের তরে।
নরোত্তম দাস মাতলেন বৈষ্ণবগীতের প্রেমে
শত কবির সাহিত্যরস সেই প্রেমেতেই জমে,
এই প্রেমের গীতেই মজেন প্রভু শ্যামানন্দ,
তার স্বরে গাইলেন রাজা আজাদ আখন্দ।
সুলতান ফতেহ শাহকে খুন করে
হাবশি প্রহরী ক্ষমতা দখল করেÑ
নামধারণ করে শাহজাদা বারবক,
তাকেও খুন করে আরেক লোক;
যাকে খুন তারই এক প্রহরী;
তাঁকেও খুন করে আরেক শিকারী,
যাঁর খুনে শেষ হয় হাবশি যুগের শাসন,
ছয় খুনে রাজা হয় চার জন।
ইথিওপিয়ার হাবশি এ চার;
এসব লেখে আজাদ এবার।
বাংলার কুর্সিতে বসে আলাউদ্দিন হোসেন,
বৌদ্ধ-বামুন-মুসলিম সবে একচোখে দেখেন।
শ্রীচৈতন্যের সাগরদকে বানালেন উজির,
স্বাধীনচিত্তে বাণী ছড়ালেন ঋষি ও পীর।
চট্টগ্রামে নিয়োগ পেলেন পরাগল ও ছুটিখান,
কবীন্দ্র ও নন্দীকে দিয়ে তারা মহাভারত লেখান।
শ্রীকর নন্দীর চোখে হোসেন শাহর আকার:
সাক্ষাৎ পুরুষোত্তম, কলিযুগের অবতার।
বিজয়গুপ্তের চোখে হোসেন বাংলার অর্জুন,
এমনি করিয়া বহু কবি গেয়েছে তাঁর গুণ।
হোসেনের পুত্র সুলতান নাসিরুদ্দিন নুসরতÑ
ইস্কান্দারনামা ও শরাফতনামায় তাঁর দস্তখত।
সুলতান ফিরোজ দ্বিজ শ্রীধরকে অনুরোধ করে,
‘বিদ্যাসুন্দর’ যোগ করেন সাহিত্য-সাগরে।
সুলতান মাহমুদ শাহর ঋজু দুর্বলতায়
দিল্লীশাহ শের সুরী বাংলার দখল পায়।
ভালোর সাথেই সদা মেশানো থাকে মন্দÑ
সময়ের গান গাইল রাজা আজাদ আখন্দ।
সেনের কাননে শুনেছিলাম ফরমান:
বাংলায় লিখলে রৌরব নরকে স্থান।
বামুনের সেই হ্কুার টুঁটিয়ে পরে,
বামুনের গান বাংলায় তর্জমা করে:
কৃত্তিবাস, কবীন্দ্র, মালাধর ও শ্রীকরে।
রুকনুদ্দিন বারবক শা’র উচ্ছ¡াসে,
রামায়ন হতে পাঁচালি রচে কৃত্তিবাসে।
মালাধর বসুরে বারবক দেন সম্মান:
প্রতিভার উপাধিÑ গুণরাজ খান।
কবীন্দ্র পয়সা নিয়ে পরাগল খাঁর থেকে,
মহাভারত আঁকলেন বাঙালির চোখে।
শ্রীকর নন্দীরে পুশলেন চাটগাঁর ছুটি খাঁ,
তার তরে ছুটিখানী মহাভারত হলো লেখা।
ফতোয়ার বিদ্রোহে ফতোয়া বোলে এ দ্ব›দ্বÑ
ফতোয়ায় গান গাইলেন আজাদ আখন্দ।
হোসেনী সুলতান মাহমুদ শাহর কালে
সুরী আফগান বাংলাদেশ নেয় দখলে।
দিল্লির মসনদ হতে শাসনাদেশ আসে-
সোনারগাঁ-গৌড়-চাটগাঁর বাংলাদেশে।
বুলগাক! বিদ্রোহের সুর করে অনুমান
শেরশাহ করেন গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড নির্মাণ।
শেরের পুত্র ইসলাম খান সুরীর আমলে
মুহম্মদ খান সুর বাংলা নেন নিজ দখলে।
নিজনামে চালু করে বাংলা সালতানাত;
ফলে বাংলায় ঘটে দিল্লীশাহীর জিয়াফত।
আপন ঠিকানায় আপন পরিচয়ের আনন্দ;
সেই আনন্দে গান গাইলেন রাজা আখন্দ।
দিল্লী হতে স্বাধীন হয়ে মুহম্মদ খান সুরী
বাংলাদেশের তখতে ঘোড়াচ্ছিলেন ছড়ি।
বাংলার শাসন নিলেন আরেক আফগানি,
সুলতান বাহাদুর তাজ খান কররানী।
তার পুত্র সুলায়মান বসলে সিংহাসনে,
বামুনপুত কালাপাহাড় এলেন সামনে।
সুলায়মানদুহিতারে বিবাহ করার পর,
মুসলমান পরিচয় জাহিরের দরকার;
পুরীর জগন্নাথ ধামে ভাঙচুর চালাইয়া,
ফেলিলেন মসজিদ-ভাঙার পরিচয় মুছিয়া!
মোগল সেনা মুনিম করল রাজধানী দখল,
উড়িষ্যায় জমা হলেন কররানী সকল।
মুনিম মরলে দাউদ ঘোষিলেন স্বাধীনতা,
রাজমহল যুদ্ধে পরাজয়ে চলে গেল তা।
আকবর ও জাহাঙ্গির বাংলার নিয়ন্ত্রণে-
বাংলাদেশে হানে ঘন ঘন অভিযানে।
পাঠান-ঈসা খান জমিদারদল লয়ে-
মোগলের বিরুদ্ধে লড়ে নিজরক্ত ক্ষয়ে।
মুক্তির নেশায় বারভুঁইয়া লড়ে যায়;
রাজা আজাদ আখন্দ তার গান গায়।
রাজা আবুল কালাম আজাদ
Raja Abul Kalam Azad is a post-modern researcher, writer, journalist, environmental activist, and teacher. He completed his bachelor's and master's degrees in disaster management at the University of Dhaka. His various research articles have been published in reputed international journals. Currently, he is working as a teacher at a government school and serving as the coordinator of the Disaster Economics Unit of Disaster Perception, a Dhaka-based organization. He is the President of the Initiatives for Bangladesh Reform Research (IBRR), Member Secretary of Bangladesh Sangskritik Andolon, and Secretary General of 'Muktatma Samiti' and one of the Members of the Independent Bangla Editorial Board.
Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial