গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান। এটি রাষ্ট্রের অন্যান্য আইনের প্রধান উৎসও বটে। সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন কোনো আইন/ আইনের অংশবিশেষও বাতিল বলে গণ্য হবে। একারণে, রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে সংবিধানে এর সমাধান খুঁজে দেখতে হয়। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের কোনো সিদ্ধান্ত, বিধি, প্রবৃধি, পরিপত্র, ইত্যাদি যদি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হয়, তবে এক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ নাগরিক প্রতিকার পেতে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়; রিট আবেদন করে। সুপ্রিম কোর্ট এসময় সংবিধান বিশ্লেষণ করেই এর সমাধান খোঁজে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যদি খুঁজে পায়, রাষ্ট্রের কোনো সিদ্ধান্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের কোনো বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, সেক্ষেত্রে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রায় দেয়। নির্বাহী বিভাগ সে রায় বাস্তবায়ন করে। এখন মূল প্রসঙ্গে আসি। সরকারি চাকুরিতে কোটা নিয়ে সংবিধান কী বলে? সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে, সংবিধানের ২৯নং অনুচ্ছেদে:
‘‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রেও কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।”
এখানে আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি চাকুরিতে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান, যারা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করার সুযোগ পায়, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পায়, তাদের সাথে বান্দরবন জেলার এক দারিদ্রপীড়িত জনগোষ্ঠীর সন্তান কি সমান সুবিধা পায়? এরকম ক্ষেত্রে, অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও উন্নত সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে একই মানের প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হলে কি সেটা সুযোগের সমতা নিশ্চিত করে?
অবশ্যই সেটা করে না। একারণেই, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯(৩)দফায় রাষ্ট্রের পিছিয়ে পড়া কোনো অংশ যেন প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যথার্থ প্রতিনিধিত্ব লাভের অভাবে আরো পিছিয়ে না যায়, সেই মহান লক্ষ্যে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়নের অনুমতি সংবিধান রাষ্ট্রকে দিয়েছে।
সংবিধানের ২৯(৩)দফায় বলা হয়:
‘‘এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই
(ক) নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে,
(খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে বা উক্ত উপ-সম্পদ্রায়ভ‚ক্ত ব্যক্তিদেও জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোন আইন কার্যকর করা হইতে,
(গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে
রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।”
সুতরাং, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগকে সরকারি চাকুরিতে কোটাব্যবস্থা প্রণয়নের অনুমতি দেয়, কিন্তু কোটা প্রয়োগের জন্য সংবিধান নির্বাহী বিভাগকে বাধ্য করে না।
সরকারি চাকুরিতে কোটা কেন যৌক্তিক?
লক্ষ্য করুন, কোটা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য বৈষম্য নিরসন, বৈষম্য তৈরি নয়।
১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন আর ২৩ বছরের বৈষম্যের পাকিস্তানি শাসনকাঠামো থেকে মুক্ত বাংলাদেশকে আগাগোড়া বৈষম্যহীন, অন্তুর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ হিসেবে বিনির্মাণের লক্ষ্যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শিতারই প্রতিফলন এই সংবিধান। জাতির পিতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, দেশকে প্রকৃত অর্থেই টেকসই করে গড়ে তুলতে হলে জনগণের কোনো অংশকে পিছিয়ে রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়। একারণেই জাতির পিতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল এমন এক সংবিধান রচনা করা যা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে থাকে; এমন এক সংবিধান প্রণয়ন করা যে সংবিধান যেন জনগণের সর্বপ্রকার ‘শোষণমুক্তি ও ‘বৈষম্য দূরীকরণ-এর পথ অবমুক্ত হয়।
একারণেই মহান সংবিধানের ১০নং অনুচ্ছেদে ‘‘মানুষের উপর মানুষের মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ’’ করাকে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। যে কোন প্রকার বৈষম্য শোষণের সৃষ্টি করে, এজন্য সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে সর্বপ্রকার বৈষম্য হ্রাসকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
তাই তো, জনগণের কোনো অংশ যেন পিছিয়ে না পড়ে, কোন অংশ যেন বঞ্চিত না হয়, সেই লক্ষ্যে রাষ্ট্র যদি কোন ব্যবস্থা নেয়, সংবিধান সেই অনুমতি রাষ্ট্রকে দিয়েছে।
সুতরাং, কোটা ব্যবস্থা যদি যথোপযুক্তভাবে প্রযুক্ত হয়, সেটা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য অনেক সহায়ক। এজন্যই জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন ঘোষণায় ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে; এবং বিশ্ব ও সমাজে সকল প্রকার বৈষম্য হ্রাস করাকে টেকসই উন্নয়নের ১০ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর কারণ, একটা দেশের বা সমাজের কোন একটা অংশ পিছিয়ে পড়লে, সেটার সেই দেশ বা সমাজের পুরো অংশের জন্য নানাবিধ ঝুঁকি তৈরি করে।
এই নীতির প্রয়োগ সরকারি চাকুরিতে প্রয়োজন। কারণ, সরকারি চাকুরির মাধ্যমে জনগণ শুধু যে কিছু সুবিধাই ভোগ করে তাই নয়, সরকারি চাকুরিজীবীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে সরকারের অংশ হয়ে উঠে বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী বিষয়ে ভূমিকা পালন করে। ফলে, নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অভাবে উক্ত সুবিধাহীন গোষ্ঠী আরো সুবিধাহীন হয়ে পরে। সুতরাং, জনগণের কোন অংশ যদি জাতীয় গড়ের চেয়ে অস্বাভাবিকভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মে অংশগ্রহণ থেকে পিছিয়ে পড়ে, সেটা তাদেরকে আরো প্রান্তিকতর করে তোলে, সেই সাথে তাদের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন হ্রাস পায়। এমন অবস্থা ঘনিভূত হলে প্রজাতন্ত্রের কোন গোষ্ঠী পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী পিছিয়ে পড়ার দুষ্টু চক্রে আপতিত হয়ে রাষ্ট্রের মূলধারার জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। এতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঐক্য, সংহতি ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
এজন্যই, জনগণের প্রতিটি আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠী থেকে প্রজাতন্ত্রের অংশগ্রহণের সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে নিবিড়ভাবে যত্ন নিতে হয়। আর, ঠিক এই কারণেই কোন গোষ্ঠী পিছিয়ে পড়লে তার সুরক্ষায় কোটাব্যবস্থা রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে।
সংবিধান অনুযায়ী কারা কতটুকু কোটা পাওয়ার অধিকার রাখে?
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯(৩) দফা অনুযায়ী কোটা পাওয়ার মূল দাবিদার ৩ প্রকারের গোষ্ঠী:
প্রকার ১: নাগরিকদের যেসব অনগ্রসর অংশ প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারছে না।
এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, (ক) মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, ৩০ লক্ষ শহীদ পরিবার এবং পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত অস্বচ্ছল পরিবার (খ) দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী (গ) পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (ঘ) নারী (ঙ) প্রতিবন্ধী ও (ছ) আর্থসামাজিক বিভিন্ন নির্দেশকের মাধ্যমে অনগ্রসর বলে প্রমাণিত অন্য কোন গোষ্ঠী।
তবে, সংবিধান অনুযায়ী এই ছয় গোষ্ঠীর মধ্যে তারাই কোটাসুবিধার যোগ্য হবেন, যাদের জনসংখ্যার অনুপাতের চেয়ে সরকারি চাকুরিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব কম।
এখানে, আরেকটি শর্ত প্রযোজ্য: এই কোটা সুবিধা এই ছয় গোষ্ঠীর কারো জন্যই স্থায়ী হওয়া উচিত নয়। এই কোটা সুবিধা ততদিন পর্যন্তই চালু থাকা উচিত যতদিন না পর্যন্ত তাদের জনসংখ্যা অনুপাতে সরকারি চাকুরিতে অংশগ্রহণের হার জাতীয় হারের সমান হয়।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ ড. আকবর আলি খান বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন:
মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে ড. আকবর আলি খান বলেন:
মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রসঙ্গে যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. আকবর আলি খান বলেন:
প্রকার ২: ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় কারণে যেসকল পদে শুধু বিশেষ ধর্মের ব্যক্তিদেরই নিয়োগ দেওয়া যায়, সেসব পদ শুধু উক্ত ধর্মাবলম্বীদের জন্য সংরক্ষণ করা।
প্রকার ৩: যেই পদে কাজ করা পুরুষের পক্ষে করা সম্ভব না, সেই পদ শুধুই নারীদেরকে এবং যেই কাজ নারীর পক্ষে করা সম্ভব না, সেই পদ শুধুই পুরুষদেও জন্য সংরক্ষণ করা।
এর ৩ প্রকারের বাইরে অন্য কোন প্রকারের কোটা সুবিধা প্রণয়ন করার সুযোগ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে নেই।
কোটা সুবিধা প্রদান করা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক?
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান জনগণের অনগ্রসর অংশের জন্য সুবিধাজনক আইন করার অনুমতি দিয়েছে মাত্র। এরূপ আইন, বিধান, বা সুবিধা প্রদানে রাষ্ট্র বাধ্য নয়।
এ ব্যাপারে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের ভাষ্য,
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন,
অনগ্রসরের কোটা অগ্রসর কাউকে দিলে রাষ্ট্রের কী ক্ষতি?
কোটা সুবিধার মূল উদ্দেশ্য: সমতা নিশ্চিত করা। এহেন ক্ষেত্রে, যদি কোনো বিশেষ আইন বা সুবিধা বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে তাদের প্রাপ্য হিস্যা থেকে বেশি সুবিধা দেয়, তবে সেটা সমতা বিনষ্ট করে, বিধায় তা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সমতা বিধানের লক্ষ্যে যুক্তিসঙ্গত কোটাপদ্ধতি রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে, অপরপক্ষে, কোন গোষ্ঠীকে প্রাপ্যাংশের অতিরিক্ত সুবিধা দিলে তা সমতাকে বিনষ্ট করে বিধায়, টেকসই উন্নয়ন নস্যাৎ করে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাষ্ট্রে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে অতিরিক্ত সুবিধা দিলে তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট কওে; বিপ্লবের জন্ম দেয়, বিশৃঙ্খলার উদ্ভব ঘটায়; যার ফলে রাষ্ট্র অস্তিত্বের হুমকিতে ভুগতে পারে। যেমন- ফরাসি বিপ্লরে উদ্ভবের কারণ যেরকম সীমাহীন বৈষম্য, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও মূল কারণ: বৈষম্য।
একারণে টেকসই, স্থিতিশীল ও নিরাপদ উন্নয়নের জন্য কোটাসুবিধা যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রদান করা হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা অতীব জরুরি।
অতএব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সরকারি চাকুরিতে কোটা প্রদানের যে মূল দর্শন, সেটা থেকে সড়ে আসলে অনগ্রসর শ্রেণি আরো অধিক অনগ্রসর হবে। সমাজে বৈষম্য আরো প্রকট হবে, দারিদ্র্যের মূল ভিত্তি (বৈষম্য) দৃঢ়তর হবে। ফলে, এসডিজি -১ এবং এসডিজি ১০ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিনতর হয়ে উঠবে। একইসঙ্গে, রূপকল্প ২০৪১-যে দারিদ্র্যবান্ধব, অন্তুর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে পালমা রেশিও ও দারিদ্র্যহার হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা ও কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নেও দরকার কোটাব্যবস্থার যুক্তিসঙ্গত সমন্বয়।
সরকারি চাকুরিতে কোটা : প্রচলিত ব্যবস্থা কতটা সংবিধানসম্মত?
সুতরাং, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করলে বর্তমানে প্রচলিত কয়েকটি কোটাব্যবস্থাকে সংবিধানসম্মত তো নয়ই বরং সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন-
(ক) মুক্তিযোদ্ধা কোটা: প্রচলিত পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে বৈধ বলে মেনে নেওয়া যাবে যদি ২টি শর্ত প্রমাণ করা যায়:
প্রথম শর্ত: মাথাপিছু আয়, মাথাপিছু গড় খাদ্য ক্যালরিগ্রহণ ও অন্যান্য উন্নয়নসূচক দ্বারা যদি প্রমাণ করা যায় যে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার দেশের জাতীয় গড়ের চেয়ে পিছিয়ে, এবং
দ্বিতীয় শর্ত: সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অংশগ্রহণের হার জাতীয় গড়ের চেয়ে কম, এবং তার জন্য প্রথম শর্ত দায়ী।
কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে মাথাপিছু জাতীয় আয়, মাথাপিছু খাদ্য ক্যালরিগ্রহণ, এবং সরকারি চাকুরিতে অংশগ্রহণের হার বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো গড়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের চেয়ে প্রত্যেকটি সূচকেই দৃশ্যমানভাবে অনেক এগিয়ে আছে।
(খ) পোষ্য কোটা: এরকম কোটার অনুমোদন সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে অনুপস্থিত। তবে, কোনো বিশেষ শ্রেণির চাকুরিজীবীর ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদেরকে পোষ্য কোটায় নিয়োগ দিতে হলে, তাদেরকেও উপরিউক্ত ২টি শর্ত পূরণ করতে হবে।
(গ) জেলা কোটা: গণপ্রজাতান্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
(ঘ) নারী কোটা: সরকারি চাকুরিতে নারী প্রতিযোগীরা আর্থসামাজিক কারণে এখনোও কিছুটা নাজুকতার শিকার হয়ে থাকেন। তবে, বর্তমান সরকারের বহুমুখী উদ্যোগের ফলে এই নাজুকতা অনেক কমে এসেছে। ইতোমধ্যে, শিক্ষার বিভিন্ন সূচকে নারীরা পুরুষের চেয়ে ভালো করছে। কিছু কিছু চাকুরিতে নারীদের সাফল্যের হার পুরুষের তুলনায় ভালো। এমতাবস্থায়, যেইসব সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণের হার এখনোও পুরুষের তুলনায় অনেক কম, এবং যেই সব সেক্টরের কার্যক্রম পুরুষের জন্য উপযোগী নয় বরং নারীদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী, সেইসব সেক্টরে যুক্তিসঙ্গত সময় পর্যন্ত কোটা রাখা উচিত।
(ঙ) ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা: ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনজাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশের মাথাপিছু জাতীয় আয় বাংলাদেশের গড় জাতীয় আয়ের চেয়ে কম। এবং, কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এখনোও এতটা পিছিয়ে যে বাংলাদেশের সরকারি চাকুরিতে তাদের অংশগ্রহণের হার নগন্য। এহেন পরিস্থিতিতে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা-আলাদা কোটা বিভাজন করে এমন একটি সমন্বিত কোটা পদ্ধতি প্রণয়ন করা উচিৎ যেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বৈষম্য প্রকট হয়ে না ওঠে। মনে রাখতে হবে: কোটা প্রণয়নের উদ্দেশ্য বৈষম্য হ্রাস, বৈষম্য সৃষ্টি নয়।
(চ)বিশেষভাবে সক্ষমদের কোটা: আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। কিন্তু, এইসব মানুষ একদিকে প্রতিবন্ধী হলেও অন্যদিক দিয়ে তারা সক্ষম। বিশেষ দিকে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবন্ধিতার দরুণ, তারা জাতীয় গড়ের চেয়ে সরকারি চাকুরিতে তাদের অংশগ্রহণ এখনও অনেক কম।
এহেন পরিস্থিতিতে, তাদের জন্য একটা সংখ্যামূল্যের কোটাব্যবস্থা বিশেষভাবে কার্যকরী নয়। সুতরাং, বিশেষভাবে সক্ষম এইসব ব্যক্তিদেরকে তাদের সক্ষমতা ও প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী বিশেষ কৌশলপত্রের মাধ্যমে তাদের জন্য কোটা প্রয়োগ করা উচিৎ। যেমন- বাংলাদেশ পুলিশে প্রতিবন্ধীদের অনেকে নিয়োগের জন্য একেবারেই উপযোগী নয়, কিন্তু প্রতিবন্ধিতার সাথে সম্পর্কযুক্ত কাজে তারা সাধারণ প্রার্থীদের চেয়ে বেশি উপযোগী। তাই, বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদেরকে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ দপ্তরে কোটা সংরক্ষণ করা উচিৎ।
কোন কোন ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা সংবিধান-সম্মত হতে পারে?
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘সুযোগের সমতা’ নিশ্চিত করে সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে প্রতিশ্রুত শোষণহীন সমাজ গড়ার মাধ্যমে এসডিজি ১০ অর্জনকে ত্বরান্বিত করা যেতে পারে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রসমূহে কোটা প্রয়োগ করার মাধ্যমে:
(ক) দরিদ্র ও অতি-দরিদ্র কোটা: জনসংখ্যার ১৮.৭% দরিদ্র পরিবারে সরকারি চাকুরিজীবীর হার ১.৮৭% ও নয় এবং এই হার ৫.৭% অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ০.৫৭% ও নয়।। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে আসা প্রতিযোগী পদে পদে নানাপ্রকার আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা পেড়িয়ে চাকুরির পরীক্ষায় ভাইভা পর্যন্ত যায়। অনেক শিক্ষার্থী মাধ্যমিকে পড়ার সময় থেকে পরিবারের হাল ধরে। টিউশনি, পার্ট-টাইম চাকুরি, রিকশা চালানো, কৃষি মজুরি ইত্যাদি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এসব পরিবারের শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা শেষ করে সরকারি চাকুরির প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। টাকার অভাবে এসব প্রার্থীরা অনেক চাকুরিতে আবেদনই করতে পারে না। সাধারণ প্রার্থীদের মতো নিয়মিত লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশুনা করে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ তাদের হয় না বললেই চলে। ঘুষ, মামা-খালুর দৌড়েও এরা পিছিয়ে।
অতএব, চাকরিটা এই শ্রেণিরই বেশি দরকার। এই শ্রেণির পরিবারে একটা সরকারি চাকুরি হওয়ার অর্থ একটা পরিবার দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেল। ফলে, এসডিজি ১, এসডিজি ২, এসডিজি ১০-সহ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের প্রায় সবগুলো অর্জনের পথেই বাংলাদেশ এগিয়ে গেল। দেশে আয়-বৈষম্য কমল। ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সুখী সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ প্রশস্ত হলো।
(খ) অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, ৩০ লক্ষ শহীদ পরিবার ও ১৯৭১ সালে প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার পরিবার: মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুফল সচ্ছল পরিবারগুলো যতটা পেয়েছে, অসচ্ছল পরিবারগুলো তা পায়নি। শিক্ষা ও চাকরিতে কোটা সুবিধা নিয়ে স্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো এতটা এগিয়ে গেছে যে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সামগ্রিক উন্নয়ন গড় জাতীয় গড়ের থেকে অনেক এগিয়ে। অপরপক্ষে, অস্বচ্ছল পরিবারগুলো শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাবে কোটা সুবিধা গ্রহণ করতে পারে নাই। সুতরাং, এহেন পরিস্থিতিতে অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে যেসব পরিবারে এখনও কোনো সরকারি চাকুরিজীবী নাই, তাদেরকে বিশেষ কৌশলপত্রসহ কোটা সুবিধার আওতায় আনা যেতে পারে।
সরকারি চাকুরিতে কোটা কখন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক?
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ শুধু বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সমতা আনার লক্ষ্যেই কোটা ব্যবস্থা অনুমোদন করেছে। অতএব, ব্যাখ্যাকৃত ব্যবস্থাদাদির বহির্ভূত অন্য কোনো কোটা ব্যবস্থা সংবিধান সমর্থন করে না।
ড. আকবর আলী খান বলেন,
কোটাপদ্ধতি সংস্কারে কার কী ভূমিকা নেওয়া উচিৎ
বাংলাদেশে সরকারি চাকুরিতে কোটাসুবিধার পক্ষে ও বিপক্ষে নানা প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও অংশীদার রয়েছেন। এইসব অংশীদারদের বোঝাপড়া ও সামগ্রিক সম্মতির মাধ্যমেই একটি গ্রহণযোগ্য, টেকসই ও যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে, আমাদেরকে ব্যক্তিস্বার্থের উর্দ্ধে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। সকল পক্ষকে ছাড় দিতে হবে। কোন বিষয় নিয়ে আন্দোলন, গণআন্দোলন ভালো কিছু নয়। একেকটা আন্দোলনে রাষ্ট্রের অনেক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। সংহতি নষ্ট হয়। শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা ও কর্মজীবীদের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। সহিংসতায় বড় ধরণের ক্ষতি হয়। রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এ কারণে, কোটাসংক্রান্ত ব্যাপারে কোন আন্দোলন দানা বাঁধতে দেওয়া উচিত নয়। বৃহৎ পরিসওে কোনো আন্দোলন দানা বাঁধার আগেই তাই উদ্ভূত পরিস্থিতির একটি শান্তিপূর্ণ, টেকসই ও যুক্তিযুক্ত সমাধানে ব্রতী হওয়া উচিৎ। ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিৎ পরিপক্ব ও দায়িত্বশীল আচরণের সর্বোচ্চটা প্রয়োগ করা। দেশের বুদ্ধিজীবী ও বিজ্ঞ সুশীল সমাজ তাঁদের প্রজ্ঞার আলোকে সঠিক দিশা দিতে পারেন রাষ্ট্রকে। আর মহামান্য আদালতের উচিত গণ-আকাক্সক্ষা, বাস্তব পরিস্থিতি ও সংবিধানের আইনের সম্মিলনে এমন কার্যকর ভূমিকা পালন, যা জাতিকে খাদে ফেলে না দিয়ে ঐক্য, সংহতি ও উন্নয়নের পথে ধাবিত করে।
আন্দোলনকারীদের উচিৎ, সরকার, মুক্তিযোদ্ধা, কিংবা বিচারপতিদেরকে গালমন্দ না করে শান্তিপূর্ণভাবে যৌক্তিক দাবিদাওয়া তুলে ধরা, পাশাপাশি আইনি পদ্ধতি বুঝে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আন্দোলনের পাশাপাশি আইনী লড়াই জারি রাখা। আইন ও বিচারপদ্ধতি সম্পর্কে জানাশোনা ব্যক্তিদের উচিৎ রাষ্ট্রপক্ষ ও আন্দোলনকারীদেরকে আইন সম্পর্কিত ব্যাপারে সঠিক পরামর্শদানের মাধ্যমে উদ্ভত পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর সমাধানে অংশ নেওয়া।
মনে রাখতে হবে, সংবিধানসম্মত ও যৌক্তিক কোটাপদ্ধতি বৈষম্যকে হ্রাস করে, অসাংবিধানিক ও অযৌক্তিক কোটাপদ্ধতি বৈষম্যকে বৃদ্ধি করে। বৈষম্য বৃদ্ধির জন্য নয়, বৈষম্য হ্রাসের জন্য যতুটুকু কোটা প্রয়োজন শুধু ততটুকুর বাস্তবায়নই তাই কাম্য। তাই কোটা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার সমাধান সংবিধানেই খুঁজতে হবে।
কোটা ব্যবস্থা নিয়ে আরো পড়ুন: মুক্তিযোদ্ধা কোটা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধান নিয়ে ১৩টি প্রশ্ন
রেফারেন্স
১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
২. কোটা পদ্ধতি চিরন্তন কোনো ব্যবস্থা নয় : আকবর আলি খান | যুগান্তর (১২ এপ্রিল ২০১৮)
৩. মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্মূল্যায়নের পক্ষে আকবর আলি খান | বিবিসি বাংলা (২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)
৪. UNGA. (2015). Transforming our world: the 2030 Agenda for Sustainable Development. A/RES/70/1
৫. সংবিধানে কোটার বৈধতা দেওয়া হয়েছে, বাধ্যতামূলক করা হয়নি | বাংলা ট্রিবিউন (১২ এপ্রিল ২০১৮)