ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় হামাস ইসরায়েলি যুদ্ধকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য একটি ‘লস-লস গেম’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশ্লেষকগণ। কারণ, আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে বাইডেনের ডেমোক্রাটিক পার্টির প্রধান সমর্থকেরা হলো_ মধ্যবৃত্ত, তরুণ, লাটিনো, আফ্রিকান, কৃষ্ণাঙ্গ, আরব, ইহুদি ও মুসলমানেরা। আবার, মার্কিন সমাজব্যবস্থায় কর্পোরেট গ্রুপ অনেক শক্তিশালী। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নানান প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে ফলাফল তৈরিতে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। মার্কিন ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট গ্রুপের সাথে ইহুদি, ইসরায়েলি ও জায়নবাদীদের সম্পৃক্ততা নানামাত্রিকভাবে ওঁৎপ্রোত। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সাথে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে চুক্তিতে আবদ্ধ যে, উক্ত প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ ও বিপণনের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো একে-অপরের সঙ্গে নির্ভরশীল। এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন নামে-বেনামে নানাধরণের ইহুদি লবি গ্রুপ রয়েছে। ইভানজেলিকাল খ্রিস্টানদের (এরা প্রধানত রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক) একটা বড় অংশ প্রকাশ্যে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ- তথা জায়নবাদের সমর্থক। একারণে, যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার মাত্র ২% ইহুদি হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইহুদিদের প্রভাব ব্যাপক।
অপরপক্ষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৩টি রাজ্যে আরব (মুসলিম ও খ্রিস্টান) ভোটাররা নির্বাচনে ফলাফল তৈরিতে নির্ণায়ক ভ‚মিকা পালন করতে পারে। এছাড়া সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমান, আফ্রিকান, ল্যাটিনো, কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয়, বামপন্থী ও তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভ‚তি বেশি। এসব ভোটারদের একটি বড় অংশ আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এসব কারণে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে একজন আদালতে দোষী সাব্যস্তকৃত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েও বেশ উৎকন্ঠার মধ্যে আছেন। ঠিক এই কারণেই গাজা যুদ্ধে নির্ণায়ক ভ‚মিকা পালন করতে গিয়ে তিনি বার বার হোঁচট খাচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ছাত্র-আন্দোলন ও আরবমিত্রদেও চাপের মুখে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিলে তিনি ইহুদি লবির চাপের মুখে পড়েন। আবার, নেতানিয়াহুর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করার পর ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করলেও বাইডেন ইসরায়েলকে ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে ইসরায়েলকে ‘আয়রনক্লাড সমর্থন’ দেওয়ার ঘোষণা ব্যক্ত করেন। বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের নেটজাহ এহুদা ব্যাটেলিয়নকে পশ্চিম তীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে জায়নবাদী গোষ্ঠী ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাইডেন একবার বলেছিলেন, ‘গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা না করলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল নীতি পরিবর্তন করবে’। কিন্তু, গাজার আঠারো সহস্রারাধিক শিশুসহ ৩৬ লক্ষাধিক বেসামরিক নাগরিকের জীবননাশও মার্কিন নীতি পরিবর্তনে বাইডেনকে প্রভাবিত করতে পারেনি।
এমতাবস্থায়, আসন্ন নির্বাচনে আরব ভোটারদের তুষ্ট করতে আরব নেতাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠকে ‘ক্ষমা চাইতে’ গিয়ে বিরম্বনার সম্মুখীন হন। এ বৈঠকে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন মানবাধিকার কর্মী রামি নাশাশিবলি বলে ওঠেন, “মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনি যখন হতাহতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন না আমাদের নিকট কী রকম নিষ্ঠুর ও পরিহাসময় মনে হয়?”
নির্বাচন ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন যে পক্ষেই তিনি অবস্থান নেন না কেন, তা অপরপক্ষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। বাইডেন যদি যেকোনো এক পক্ষেরও সমর্থন হারান, তা তার পরাজয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। এমতাবস্থায়, মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাঁচার পথ হলো ফিলিস্তিনে উভয়পক্ষের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা। কিন্তু, বিধি বাম। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বাইডেনের এরকম নিরাপদ পথ-পদ্ধতি প্রণয়নকে জটিল করে তুলেছে।
ইসরায়েলে এখন ইতিহাসের সবচেয়ে রক্ষণশীল জোট ক্ষমতায়। যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দিলে নেতানিয়াহুর জোট সরকার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যুদ্ধমন্ত্রিসভার অতিডানপন্থী নেতারা। তারা যদি বের হয়ে যায়, আগাম নির্বাচন দিতে হবে নেতানিয়াহুকে। আর, নির্বাচনে নেতানিয়াহুর জয়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। আবার, গদি হারালে নেতানিয়াহুকে জেতে হবে জেলে। কারণ, দুর্নীতি ও ইসরায়েলের বিচারব্যস্থা দুর্বল করার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও অভিযোগ দুইই আছে। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে ঝুলছে যুদ্ধাপরাধের মামলা।
এমতাবস্থায়, চাইলেও বাইডেনের নির্বাচনে জেতার পথ প্রশস্ত করার প্রয়াসে যুদ্ধবিরতিতে এতোটা সহজে রাজী হতে পারছেন না নেতানিয়াহু। সম্প্রতি, বাইডেন ৩ ধাপবিশিষ্ট একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপণ করে বলেছে, ‘এটি ইসরায়েলের প্রস্তাব।’
এর প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহু বলছে, “হামাসকে নির্মূল করার আগে থামবে না ইসরায়েল।” সুতরাং, বাইডেনের প্রস্তাবে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির উপাদান থাকলেও তার স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নাই। ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তির পরে হামাসকে ধরে যে খতম করে দেওয়া হতে পারে, এর পূর্বাভাস নেতানিয়াহুর বক্তব্যেই পেয়েছে হামাস। সুতরাং, বাইডেন ঘোষিত ইসরায়েলি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে শুরুতে ইতিবাচকভাবে দেখলেও এখন ‘ফাঁদ’ হিসেবেই দেখছে হামাস। ফলে, প্রতিরোধে ঘোষণাই বহাল রাখল তারা।
ইসরায়েল এবং মার্কিন রাজনীতির এই টান-টান উত্তেজনাকর জটিলাবস্থার বলি হচ্ছে ফিলিস্তিনের শত সহস্র শিশু, নারী, আবালবৃদ্ধবণিতা। নিরন্ন, নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের লাশের সারি দীর্ঘতর হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফিলিস্তিনিদের এই রক্তদান এই আত্মবলিদান ইসরায়েলকে কি আসলেই খুব উপকার দিচ্ছে? এই প্রশ্নটি ইতোমধ্যে ইসরায়েলের নাগরিকরাই করতে শুরু করেছেন। কারণ, ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুসহ বেসামরিক নাগরিকগণেকে যেভাবে বোমা মেরে, গুলি করে, পুড়িয়ে মারা হচ্ছে সেগুলো শত বিধিনিষেধ আরোপ করেও লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বিভৎস সব ছবি আর ভিডিওগুলো অনলাইনে ঘুরছে। অনলাইনের কল্যাণে ইসরাইল ও ইহুদি জাতির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হয়ে থাকছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও প্রধান প্রসিকিউটর স্বয়ং যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত নেতানিয়াহু ও ইয়োভ গ্যালান্টের (হামাসের ৩ নেতাকেও ) গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে আদালত-দ্বয় থেকে ইসরায়েল কতোটা রক্ষা পাবে, সেটা বলা যায় না। তবে, ইতোমধ্যে পশ্চিমাবিশ্বেও অনেক দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ইউরোপের ৪টি দেশ সম্প্রতিই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্বের সাধারণ নাগরিকদের মনে ইসরায়েল সংঘটিত গণহত্যা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন ৫০%-এর নিচে নেমে গেছে। ইসরায়েলের ইতিহাসে দেশটি এখন বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন। এর প্রভাব দেশটির অর্থনীতিতে এখনই পড়তে শুরু করছে। কিন্তু, এর থেকেও সবচেয়ে বড় ভয়, যেটি ইসরায়েলের অনেক নাগরিকের মনে তৈরি হচ্ছে: বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপট তো আর সবসময় ইসরায়েলের অনুকূলে থাকবে না। ভূরাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হলে এমন সময় তো আসবে না, যখন, গাজায় ইসরায়েলিদের পরিচালিত গণহত্যার ছবি-ভিডিও ইসরায়েল ও ইহুদি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে? সুতরাং, নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বাইডেন-নেতানিয়াহু শুধু নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে- এতটুকুই নয়, তারা মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে রেখে যাচ্ছেন বলেই অনেক বিশ্লেষকের মত।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সম্পর্কে আরো পড়ুন
জেরুসালেমের মালিকানা আসলে কার?