এক পল্লী গাঁয়ের ঈদ!

আমাদের গাঁয়ে একেকজনের ঈদ আসে একেক অর্থে, একেক অবয়বে!

রবিউল (ছদ্মনাম) এর জীবনে ঈদ মানে বেঁচাকেনার মৌসুম। সাত-সকালে উঠে ছোলা সিদ্ধ করা, বিভিন্ন মসলা চানাচুর প্রস্তুত করতে করতে ঈদ্গাহের কোন স্থানে বসলে বেশি বেঁচাকেনা হবে, কোথায় রোদ লাগবে না_এইসব ভাবনা-কর্ম নিয়ে তার ঈদের দিন শুরু হয়। ৫ মিনিট দোকান স্থগিত রেখে ছয় তাকবিরের নামাজ তার কখনো হয়ে ওঠে, কখনো হয়ে ওঠে না!

দিনমজুর নওয়াজেসের স্ত্রী হাসিনা বেগম (ছদ্মনাম) খুব মন খারাপ নিয়ে ফজর নামাজটা পড়ে সেমাই রান্না করে। তার দুঃখ সেমাইয়ে দুধ নাই। প্রতিবেশীর সুগন্ধী সেমাইয়ের গন্ধ ভেসে আসে তার উঠোনে। তার নয় বছরের শিশুপুত্র শিমন বুঝতে পারে, তাদের সেমাই আর প্রতিবেশী রবিনদের সেমাইয়ের স্বাদ-গন্ধ আলাদা। কিন্তু, মা যেন কষ্ট না পায়, তাই সেও বুঝতে দেয় না যে সে সব বোঝে। নওয়াজেস আদুধে সেমাই গপাগপ খায় আর ছেলেকে বলে, “এ গেদা, সেমাই খুব মিঠা! খা, খা। খায়া মাঠে যাই চল। চানাচুর কিনে দেই।”

মধ্যবৃত্ত পরিবারের প্রৌঢ়া শেফালি বেগমের (ছদ্মনাম) ঈদ শুরু হয় সকাল সকাল নাতিপুতির হাসির কলরবে। অনেকদিন পর বড় নাতনি ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছে। রাতভর নানির সাথে নাতি-নাতনিদের কতো গল্প-খুনসুটি, আহ্লাদ আনন্দের ধারা রাত পেরিয়ে সকাল গড়িয়ে সন্ধা অবধি নামতে চায়! তার আনন্দের ধারায় ছেদ পড়ে স্বামী সামশেদ সাহেবের খেকি শুনে: ১৫০ টাকা সের দুধের সেমাই; ৩ প্রকার সেমাইয়ের সব প্রকারেই লবণ কম হলো কেন, এই তার খেকির কারণ ।

মুয়াজ্জিন ময়নাল হুজুরের (ছদ্মনাম) ঘুম ভাংগে রাত ২টায়। সেহেরির জন্য আজ আর ডাকতে হবে না, তাকে তবু রুটিনের সময় কী এক অজানা কারণে তার মন খচখচ করে। দু রাকাত তাহাজ্জুদে দাড়িয়ে সে রাকাত ভুলে যায়! নামাজের রুকুতে ভাবনায় আসে, এতো কষ্ট করে রাত জেগে মাইকে ডেকে সে কত পেলো, তারাবির হুজুর ছোকরা কত পেল আর রাত পোহালে ১ঘন্টায় ঈদগাহের হুজুর কত পাবে, তার তুলনায়।

বিধবা পরহেজগার রহিমা বিবি (ছদ্মনাম) দাতের ব্যথা আর না-ঘুমানো ঘুমের তন্দ্রাচ্ছন্নতা উপেক্ষা করে তাহাজ্জুদে ওঠে। আল্লাহর কাছে, রোনাজারি করে, “আল্লাহ, দুনিয়ায় কষ্ট দিলা। পরকালে একটু শান্তি দিও।”

ভোরবেলা, হঠাৎই তার মেজাজ ফুরফুরে হয় যায়! ঈদুল ফিতর! দীর্ঘ ৩০দিন রোজা রেখে আজ প্রথম রোজা ভঙ্গের আনন্দ এটি!
১০ বছরের সুমন (ছদ্মনাম) প্রথমবারের মতো ৩০টি রোজাই রেখেছে এবার! ঈদের দিন আজ তার এতো আনন্দ লাগছে কেন, সে নিজেই বুঝতে পারছে না। তার দরিদ্র পিতার ২০টাকার নোটকে ২০ কোটি টাকার দান মনে করে খুশি মনে ঈদ্গাহে যায়।

এইভাবে একই গ্রামে একই পরিবারে একেকজনের নিকট ঈদুল ফিতর একেক রকম হয়ে ধরা দেয়। এই বাইরে, ভিন গায়ের দুই কিশোরের মধ্যে ঈদের পার্থক্য হয় সংস্কৃতির নানান উপকরণের পার্থক্যের জন্য । গ্রাম ও শহরের কিশোর-যুবাদের ঈদের পার্থক্য আরো বেশি; আরো বেশি উপাদানের পার্থক্যের নিরিখে।

সুদূর সৌদি আরবের কিশোর নায়েফ আল রোদানের ঈদ, সেনেগালের যুবক বোউবাকার কেইটার ঈদ আর বাংলাদেশের পল্লি গাঁয়ের কিশোরী সবিতা খাতুনের ঈদ তাই এক নয়।

সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলমান শিশু-কিশোর-যুবা-প্রৌঢ়-বৃদ্ধ নর-নারীর ঈদ মঙ্গলজনক, কল্যাণকর, বরকতময় ও রহমতপূর্ণ হোক।

ঈদ মোবারক!
author

রাজা আবুল কালাম আজাদ

Raja Abul Kalam Azad is a post-modern researcher, writer, journalist, environmental activist, and teacher. He completed his bachelor's and master's degrees in disaster management at the University of Dhaka. His various research articles have been published in reputed international journals. Currently, he is working as a teacher at a government school and serving as the coordinator of the Disaster Economics Unit of Disaster Perception, a Dhaka-based organization. He is the Secretary General of 'Muktatma Samiti' and one of the Members of the Independent Bangla Editorial Board.

এই ধরণের আরো...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial